জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন

তাবাসসুম মাহমুদ

প্রকাশ : ২৯ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে পরিবেশ-প্রতিবেশব্যবস্থা ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেমে আসে বিপর্যয়। প্রকৃতিতে নদনদী, হাওর, পাহাড়, বন ইত্যাদির ভূমিকা সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে আমরা প্রতিনিয়ত এগুলো ধ্বংস করে চলেছি। নদনদী দখল-ভরাট-দূষণ, বন উজাড়, পাহাড় কাটা, দারিদ্র্য, অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি ও বায়ুদূষণ, শিল্প-কারখানার দূষণ, মাত্রাতিরিক্ত ও ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার, ভূগর্ভস্থ পানির অত্যধিক উত্তোলনে বাংলাদেশের পরিবেশ আজ বিপর্যস্ত। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। নদনদী, খাল-বিল, হাওর, জলাশয় এ দেশের প্রাণ। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং নৌচলাচল, কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশে ছোট-বড় ৩০০টির বেশি নদী রয়েছে। যার মধ্যে অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের এবং ৩টি মিয়ানমারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। পদ্মা, মেঘনা, যুমনা বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদী। মানুষের অত্যাচারে নদীগুলো আজ মৃতপ্রায়।

বাংলাদেশের নদীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার : উজান দেশের সঙ্গে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অনেক অমীমাংসিত বিষয় নিষ্পন্ন না হওয়ায় এ দেশের নদীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তিস্তার পানিপ্রবাহ ব্যাপকহারে কমে গেছে। পদ্মা, তিস্তা এখন মৃতপ্রায়। যুমনায় পড়েছে চর। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা দখল ও দূষণের ভারে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। সারা দেশের নদীগুলো দখল-ভরাটে নিস্তব্ধ, স্রোতহীন। দূষণের ভারে পানি ব্যবহারের অযোগ্য এবং জীববৈচিত্র্য শূন্য। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ আজ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, বাঁধ নির্মাণসহ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে নদীবাহিত পলিপ্রবাহের কারণে পানি সাগরে যেতে পারছে না। নদীর তলদেশ ভরে যাচ্ছে। কমে যাচ্ছে নদীর নব্যতা। দেশের প্রায় ১৪০টি নদনদী এখন মৃত প্রায়। দেশের প্রায় ১৩টি নদীর অস্তিত্ব এখন বিলীনের পথে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এসব নদী।

খাল-বিল ও নদনদী শুকিয়ে যাচ্ছে : জনসংখ্যা বাড়ছে, কমছে কৃষিজমি। কৃষিজমি কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। প্রতিবছর ৬৮,৭৬০ হেক্টর চাষাবাদযোগ্য জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। দেশে বর্তমানে ৮.৫২ মিলিয়ন হেক্টর কৃষি জমি রয়েছে। ১৯৭৬ সালে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯.৭৬২ মিলিয়ন হেক্টর। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঋতুর বৈশিষ্ট্য হারিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রার আমূল পরিবর্তন ঘটছে। জমির অতিকর্ষণে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে। টপসয়েলের আস্তরণ কমে যাচ্ছে। একই জমি বারবার চাষ করার ফলে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। দেশীয় ধানের জাত ১৯৮২ সালে ১২৪৮৭টি, ২০১৪ সালে ৭০০০টি (বিএআরআই) রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে ইরি চাষের জন্য প্রচুর সেচের প্রয়োজন হয়। এতে ১২০০ থেকে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রয়োজর হয়। সেচের পানি ভূগর্ভ ও ভূপৃষ্ঠ দু-উৎস থেকেই আসে। খাল-বিল, নদনদী শুকিয়ে যায়। দেশের অনেক জায়গায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় উত্তোলনে এবং সেই ভূগর্ভস্থ পানির অপর্যাপ্ত পরিপূরণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আহরণ ক্ষমতার নিচে নেমে যাচ্ছে। দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে বিগত ৩০ বছর (১৯৮১-২০১০) বার্ষিক গড় ১.৪ শতাংশ হারে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।

বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ দেশে প্রকৃতির হাহাকার : বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী বৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ। বাংলাদেশে প্রায় ৯৮২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিচরণ করে। এর মধ্যে ৫৩ প্রজাতির উভচর, ১৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬৫০ প্রজাতির পাখি এবং ১২১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। উভচর প্রাণীর অধিকাংশই ব্যাঙ। গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলাদেশ ব্যাঙের পা রপ্তানি করে কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারকে উৎসাহিত করে। ব্যাঙ ক্ষতিকর ৪৫ ধরনের পোকাণ্ডমাকড় খেয়ে থাকে। সরীসৃপ প্রাণীর ৩০ প্রজাতির কাছিমের প্রায় সবগুলোই বিপন্নের তালিকায়। বাংলাদেশে ২ প্রজাতির কুমির দেখা যায়। একটি লোনা পানির কুমির, অন্যটি ঘড়িয়াল। মিঠাপানির কুমির প্রায় সব নদীতে ছিল; যা বর্তমানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির বন্যপ্রাণী হারিয়ে গেছে এবং ৪০ প্রজাতি স্তন্যপায়ী, ৪১ প্রজাতি পাখি, ৫৮ প্রজাতি সরীসৃপ ও ৪ প্রজাতি উভচর প্রাণী হুমকির সম্মুখীন। গত ৪০ বছরে মধুপুর শালবনের ৮৫ শতাংশ ধ্বংস করা হয়েছে। চিংড়ি চাষের নামে চকোরিয়া ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। বিশ্বের একক সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বাংলাদেশের সুন্দরবন। বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বসবাস সুন্দরবনে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার আমাদের জাতীয় পশু এবং সুন্দরবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রায় ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ, বনজ সম্পদের নির্বিচার আহরণ, বন্যপ্রাণী শিকার ইত্যাদি কারণে সুন্দরবনের অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববেচিত্র্যের এক অনন্য নিদর্শন সুন্দরবন। সুন্দরবনকে রক্ষা করে বাঘ (২০০৪ সালে ৪৪০টি, ২০০৬ সালে ২০০টি, ২০১৫ সালে ১০৬টি)। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন।

যার অভাবে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয় : হাওর এলাকা প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার। সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৩৭৩টি হাওর বা জলাভূমি রয়েছে। এ সকল হাওরের জৈব বৈশিষ্ট্যগুলো দৃশ্যত অনন্য ও আকর্ষণীয়। অতীতে হাওর অববাহিকার প্রাণবৈচিত্র্য ছিল অতি সমৃদ্ধ। কিন্তু পরিবেশগত অবক্ষয়ের কারণে প্রাণবৈচিত্র্যের এ প্রাচুর্য বর্তমানে ক্রমক্ষয়িষ্ণু। ঢাকা মহানগরীতে অধিক হারে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই ভূগর্ভে পানির শূন্যতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহানগরীতে যেখানে ১৯৭০ সালে ৪৯টি গভীর নলকূপ ছিল, বর্তমানে তা প্রায় ৭০০টি। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিবছর পানির স্তর ১০ ফুট করে নিচে নামছে। ভূগর্ভে লবণ পানির অনুপ্রবেশ চলতে থাকলে ২০ থেকে ৩০ বছর পর মিঠা পানির অভাবে ঢাকায় জনশূন্যের পাশাপাশি ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে। ঢাকায় জলাশয় ও নিম্নাঞ্চলের পরিমাণ ছিল ১৯৬০ সালে যথাক্রমে ২৯৫২ ও ১৩৫২৮ হেক্টর, ১৯৮৮ সালে যথাক্রমে ২১০৪ ও ১২৭১৮ হেক্টর এবং ২০০৮ সালে যথাক্রমে ১৯৯১ ও ৬৪১৫ হেক্টর। ১৯৬০ সাল হতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল যথাক্রমে ৩২.৫০ শতাংশ ও ৫২.৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট ও দখলের ফলে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নগরবাসী প্রতিনিয়ত জলাবদ্ধার শিকার হচ্ছে।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে করণীয় : এসব পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয় হলো, পানিসম্পদ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করা পাশাপাশি ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। নদনদী দখল-ভরাট-দূষণমুক্ত করা এবং খননের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধিপূর্বক পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো। যেসব এলাকায় পানির অভাব রয়েছে, সেখানে ইরি চাষ পরিহার করে দেশীয় জাতের ধান চাষ করা। প্রকৃতিনির্ভর দেশীয় জাতের ধানের ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা। উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় মাছের চাষ করা এবং এসব মাছের ফলন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা। নির্বিচারে বনভূমি উজাড় রোধ এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চল যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ব্যবহার করা। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ পাহাড় ও হাওর প্রতিবেশব্যবস্থা সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক