ঘূর্ণিঝড় আল্লাহর খুব সাধারণ একটি সৃষ্টি; যার নিজস্ব শক্তি বলতে কিছুই নেই। আগুন-পানি, আলো-বাতাস আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত; যেগুলোকে কেন্দ্র করে আমাদের বেঁচে থাকা। আল্লাহতায়ালা কখনো এসব শক্তিমান সৃষ্টির মাধ্যমে মানবজাতিকে নানা পরীক্ষা করে থাকেন। ঘূর্ণিঝড় আল্লাহতায়ালার সেই বিশেষ পরীক্ষার অন্যতম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ভালো-মন্দ দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করি।’ (সুরা আম্বিয়া : ৩৫)। আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এর ব্যাখ্যা হলো- আমি কখনো তোমাদের ওপর বিপদাপদ নাজিল করি এবং কখনো নেয়ামতরাজি দান করি। উদ্দেশ্য হলো পরীক্ষা করা যে, নেয়ামত পেয়ে কে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, আর কে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে! এবং দুঃখ-কষ্টে কে সবর করে, আর কে নিরাশ হয়ে যায়! (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৫/৩৪২)। এসব বালা-মসিবত কেন আসে? আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে থাকে, তা তোমাদের কৃতকর্মেরই ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে থাকেন।’ (সুরা শুরা : ৩০)।
ঘূর্ণিঝড় আল্লাহর পরীক্ষা : প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপদাপদ যে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে পরীক্ষা, এ কথাটি হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন।’ (বোখারি : ৫৬৪৫)। বিপদের সঙ্গে বান্দার ভালো-মন্দের সম্পর্ক। আরেক হাদিসে বিষয়টি আরো স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান, তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন; আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান, তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কেয়ামতের দিন তার প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন।’ (তিরমিজি : ২৩৯৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, বড় পুরস্কার বড় বিপদের সঙ্গেই রয়েছে। আর আল্লাহ যখন কোনো সম্প্রদায়কে ভালোবাসেন, তখন অবশ্যই তাদের পরীক্ষায় ফেলেন। তখন যে সন্তুষ্ট থাকে, তার জন্যই তাঁর সন্তুষ্টি; আর যে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে, তার প্রতি তাঁরও অসন্তুষ্টি।
ঘূর্ণিঝড়ে ইসলামের নিদের্শনা-
১. ধৈর্য ধারণ করা : পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য চাও, নিশ্চয় আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সুরা বাকারা : ১৫৩)। ওয়াক্তিয়া ফরজ নামাজ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে নফল নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিখারীর মতো দোয়া করা।
২. দান-সদকা করা : হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, দান-সদকা বিপদাপদ দূর করে; যত বড় বিপদ হোক না কেন। দান-সদকা এমন এক আমল, যার মাধ্যমে অনেক অসম্ভব সম্ভব হয়।
৩. তওবা-ইস্তিগফার করা : তওবা-ইস্তিগফার হলো একজন মানুষের হাতিয়ার। চাই সে কাফের হোক বা মুসলমান। তওবা-ইস্তিগফার দ্বারা হাজারো বালা-মসিবত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনি তাদের মাঝে থাকাবস্থায় কিছুতেই আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না। আর তারা ক্ষমা প্রার্থনা করাবস্থায়ও তাদের শাস্তি দেবেন না।’ (সুরা আনফাল : ৩৩)। এ আয়াত থেকে বুঝে আসে, এমনকি তওবা-ইস্তিগফারের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো জাতির ওপর শাস্তি আসার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও সে শাস্তিকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে রাসুল (সা.)-এর বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে, আল্লাহতায়ালা তার সব সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দেন, তার সব পেরেশানি দূর করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৫১৮)।
৪. বেশি বেশি দোয়া পাঠ করা : প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে হা-হুতাশ না করে বেশি বেশি দোয়ায়ে ইউনুস পাঠ করা চাই। এ দোয়া হলো জাদুর মতো। এর আমল যতই করা হবে, ততই সব সমস্যা নীরবে শেষ হয়ে যাবে। তবে ঈমান ও একিনের সঙ্গে পড়তে হবে।
৫. সম্মিলিত দোয়া করা : ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিপদে একাধিক ব্যক্তি যখন খুব কাকুতি-মিনতি করে দোয়া করবে, আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তা কবুল করবেন। হাবিব ইবনে মাসলামা আল ফিহরি (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কিছু মানুষ যখন কোথাও একত্র হয়ে এভাবে দোয়া করে যে, একজন দোয়া করে এবং অন্যরা আমিন বলে, সে ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালা অবশ্যই তাদের দোয়া কবুল করেন।’ (আল মুজামুল কাবির লিত তাবারানি : ৩৫৩৬, মুসতাদরাকে হাকেম : ৫৪৭৮, মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ১৭৩৪৭)।
৬. নিরাপদ স্থানে যাওয়া : ঝড়-বৃষ্টিতে কোরআন-হাদিসে সচেতনতা অর্জন করার কথা খুব গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে। মক্কা শরিফ থেকে মদিনা শরিফ হিজরতের সময় হেরা গুহার কথা নিশ্চয় আমাদের মনে আছে। প্রথমে আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করতে হবে, যেন আমরা বিপদ থেকে রক্ষা পাই। তারপর আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর প্রায় ১০ বছরের খাদেম আনাস ইবনে মালেক (রা.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি কীভাবে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করব? আমার উটনীটি ছেড়ে দিয়ে নাকি বেঁধে রেখে?’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘প্রথমে তোমার উটনীটি বাঁধ, এরপর আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল কর।’ (তিরমিজি : ২৫১৭)।
ঘূর্ণিঝড়ে যা বর্জনীয় : আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা থেকে বেঁচে থাকার পাশাপাশি বাকি সব গোনাহ ছেড়ে দেয়া। কারণ, গোনাহ এমন এক বিষয়, যা একজন গোনাহগারকে আসমানে পাপী বলে চিহ্নিত করে। অগণিত ফেরেশতা তাকে পাপী হিসেবে চেনে। কারণ, প্রতিদিন ফেরেশতারা তার আমল নিয়ে আল্লাহর কাছে হাজির হন। আবার আজাবের ফেরেশতারা আসমান থেকে ঘূর্ণিঝড়ের মতো আজাব নিয়ে আসেন। তাই সারকথা কথা হলো, আমাদের গোনাহের কারণেই এসব ঘূর্ণিঝড় আসে বলে আমাদের গোনাহমুক্ত জীবন গড়তে প্রতীজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আর গোনাহ হচ্ছে সব আজাবের মূল। তাই আমরা গোনাহ বা পাপ করা ছেড়ে দিয়ে যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর কথামতো জীবন গড়ি, তাহলে আল্লাহর শাস্তি ও আজাব থেকে রেহাই পাব। এসব মসিবতে যারা আমলের পাশাপাশি আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থেকে ধৈর্য ধারণ করবে, ঝড়-বৃষ্টিতে তাদের সামান্য ক্ষতি হলেও আখেরাতে তারা অনেক বেশি লাভবান হবেন। এর বিপরীতে যারা আমল না করে অধৈর্য হয়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, অশুভ কথাবার্তা বলে, তাদের জন্য এই ঘূর্ণিঝড় শাস্তি। ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের একমাত্র বর্জনীয় বিষয় গোনাহ।