প্রকৃতির ভালো-মন্দসহ সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা আল্লাহর অধীনে। এসব কিছু শুধু তাঁর আদেশেই হয়। তাঁর হুকুম ও আদেশের বাইরে গাছের একটি পাতাও নড়ে না। নদীর এক ফোঁটা পানিও বয়ে যায় না। ঠিক তেমনি বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, টর্নেডো ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এতে মানুষের কোনো হাত নেই।
এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যে কোনো দেশে এবং যে কোনো শহরে যে কোনো মুহূর্তে হানা দিতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’ও আমাদের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। এ সময় প্রয়োজনীয় সুরক্ষা-ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ হতে হবে। ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা নয়, বরং এর ক্ষতি থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে করুণা চাইতে হবে।
কেননা, আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী এরূপ পরীক্ষা ও বিপদাপদ আসে মানুষের গোনাহের কারণে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘জলে-স্থলে বিপর্যয় মানুষের কৃতকর্মের ফল।’ (সুরা রুম : ৪১)। তাই যে কোনো কঠিন পরিস্থিতিতে হতাশ না হয়ে নিজের গোনাহের জন্য আল্লাহর কাছে তওবা করা ও বেশি বেশি তাকে স্মরণ করা চাই।
দুর্যোগ-বিপর্যয় পাপের ফল : পবিত্র কোরআনে দুর্যোগের বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং জানমাল ও ফলফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও; যারা নিজেদের বিপদণ্ডমসিবতের সময় বলে, নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপর রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত। আর তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত।’ (সুরা বাকারা : ১৫৫-১৫৭)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তোমাদের ওপর যেসব বিপদাপদ আসে, তা তোমাদেরই কর্মফল। তিনি অনেক গোনাহ মাফ করে দেন।’ (সুরা শুরা : ৩০)। কোরআনের অসংখ্য আয়াত ও নবীজি (সা.)-এর অনেক হাদিস থেকে বোঝা যায়, বিশ্বজুড়ে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধেয়ে আসে, সেগুলো মানুষের পাপের ফসল। এসব বিপদাপদ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বস্তুত সতর্ক করেন। যেন আমরা সহজ-সরল পথ অবলম্বন করি। সমাজ ও দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন পাপ, ব্যাভিচার, অন্যায় এবং আল্লাহকে ভুলতে বসে, তখনই আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে জমিনবাসীর জন্য শাস্তির ফয়সালা নেমে আসে।
আপদণ্ডবিপদ বান্দার পরীক্ষা : যখন কোথাও ভূমিকম্প সংঘটিত হয় অথবা সূর্যগ্রহণ হয়, ঝড়-বাতাস বা বন্যা হয়, তখন সবার উচিত মহান আল্লাহর কাছে তওবা করা, তাঁকে স্মরণ করা, তাঁর কাছে নিরাপত্তার জন্য দোয়া এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা। কেননা, মহান আল্লাহ পৃথিবীতে নানাবিধ আপদণ্ডবিপদ ও মসিবত দিয়ে বান্দাকে পরীক্ষা করেন।
সব রকম বিপদাপদে হেফাজত থাকার কলাকৌশল, দোয়া, জিকির-আজকার কোরআন-হাদিসে এসেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় কিছু দোয়া বা আমলের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার সুযোগ রয়েছে। রাসুল (সা.) তার উম্মতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। যেন উম্মতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দিয়ে একসঙ্গে ধ্বংস না করা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রাসুল (সা.) বেশি বেশি তওবা-ইস্তেগফার করতেন। অন্যদেরও তা পড়ার নির্দেশ দিতেন।
ঝড়-বৃষ্টিতে রাসুল (সা.) শঙ্কাগ্রস্ত হতেন : আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছি যে, ‘লোকজন মেঘ দেখলে বৃষ্টির আশায় আনন্দিত হয়ে থাকে, আর আপনি তা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন কেন?’ জবাবে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি এ ভেবে শঙ্কিত হই যে, বৃষ্টি আমার উম্মতের ওপর আজাব হিসেবে পতিত হয় কি না! কেননা, আগের উম্মতদের ওপর এ পদ্ধতিতে (বৃষ্টি বর্ষণের আকারে) আজাব পতিত হয়েছিল।’ (মুসলিম : ৮৯৯, তিরমিজি : ৩৪৪৯)।
দমকা হওয়ায় নবীজি (সা.) যা করতেন : সাহাবিদের জীবনে আমরা দেখি, বিপদে-মসিবতে তারা নামাজে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ : ৫৩৪৫)। ঝড়-তুফানের প্রাদুর্ভাব ঘটলে তাকবির তথা আল্লাহু আকবার বলা ও আজান দেয়া সুন্নত। (তবে এ আজানে ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বাক্যদ্বয় বলার প্রয়োজন নেই)। দমকা হওয়া বইতে দেখলে রাসুল (সা.) আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যেতেন। উদ্বিগ্ন হয়ে চলাফেরা করতেন। যখন বৃষ্টি হতো, তখন তিনি খুশি হতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, যখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতো এবং ঝড়ো বাতাস বইত, তখন রাসুল (সা.)-এর চেহারায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠত। এ অবস্থা দেখে তিনি এদিক-সেদিক পায়চারি করতে থাকতেন এবং এ দোয়া পড়তেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খাইরাহা ওয়া খাইরা মা-ফিহা ওয়া খাইরা মা-উরসিলাত বিহি, ওয়া আউজুবিকা মিন শাররিহা ওয়া শাররি মা-ফিহা ওয়া শাররি মা-উরসিলাত বিহি। (অর্থ : হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে এ বৃষ্টির কল্যাণ কামনা করছি;, এ বৃষ্টিতে যেসব কল্যাণ রয়েছে, সেগুলো কামনা করছি এবং এ বৃষ্টির মাধ্যমে প্রেরিত কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আর এ বৃষ্টি এবং বৃষ্টির মাধ্যমে প্রেরিত সব রকম অকল্যাণ ও বিপদাপদ থেকে পরিত্রাণ চাই।’ এরপর যখন বৃষ্টি হতো, তখন মহানবী (সা.) শান্ত হতেন। (বোখারি : ৩২০৬)।