ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রকৃতি এক অপরূপ শিল্প

আবু তালহা তোফায়েল
প্রকৃতি এক অপরূপ শিল্প

প্রকৃতি আল্লাহর নিদর্শন অথবা সহজ ভাষায় বলতে পারি, প্রকৃতি আল্লাহর অপার নেয়ামত। এ পৃথিবীর যেখানে আমরা মানবজাতিসহ বিভিন্ন প্রাণী বাস করি, তা নিঃসন্দেহে খুবই চমকপ্রদ। আমরা আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে নানা ধরনের ফল-ফুল ও সুন্দর সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই। এগুলো একজন ঈমানদারের কাছে স্রেফ আল্লাহর নিদর্শন মনে হয়। পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে, ‘তিনি সেই সত্তা, যিনি ভূ-তলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে অটল পাহাড় ও নদ-নদী সৃষ্টি করেছেন। আর প্রত্যেক ফল জোড়ায়-জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি রাতের আবরণে দিনকে আবৃত করেন। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’ প্রকৃতির ধর্ম বলা হয় ইসলামকে। কেননা, আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ হচ্ছে সামাজিক জীব। এই মানুষ জাতিকে নিয়েই পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, সমাজ ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও সুন্দর প্রকৃতি নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য। তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝরনাধারা; যাতে তারা ফল খায়।’ (সুরা ইয়াসিন : ৩৩)।

প্রকৃতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ : কবি বলেছেন, এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি/খোদা তোমার মেহেরবানি। পৃথিবীতে মানুষ আসার বহু আগেই মেহেরবান আল্লাহ তাঁর অপার নেয়ামতে প্রকৃতি ও পরিবেশকে সাজিয়েছেন। পরিবেশ ও প্রকৃতির মৌলিক উপাদান হচ্ছে মাটি ও পানি। মূলত মাটি থেকে গাছপালা, তরুলতা, শাকসবজি ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত শস্য পানি থেকে প্রাণ সঞ্চার করে। প্রকৃতি ও পরিবেশ আল্লাহর মেহেরবানির আরেকটি দিক হচ্ছে আলো। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি অনুধাবন করে না, আমি রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকিত। এতে মোমিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নামল : ৮৬)।

প্রকৃতি আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন : বস্তুত এ নিখিল বিশ্বে রয়েছে আসমান-জমিন, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালাসহ অসংখ্য সৃষ্টিরাজি। মহান আল্লাহ ভাসমান চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ও অসংখ্য তারকা দ্বারা আসমানকে সুসজ্জিত করেছেন। এই সুসজ্জিত আসমান আল্লাহর কুদরতের এক বিশেষ নিদর্শন। তিনি বিস্তৃত ও বিশাল পৃথিবীকে বিন্যাস করেছেন বৈচিত্র্যময় পাহাড়-পর্বত, খাল-বিল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর ও সারি সারি বৃক্ষ ও তৃণলতার সমারোহে। এতে রয়েছে মানুষসহ হাজারো রকমের জীব-জানোয়ার ও পশুপাখি। মানুষের পুষ্টি ও তৃপ্তির জন্য আল্লাহতায়ালা এ স্থলভূমিতে নানা রকমের খাদ্যশস্য ও সবজির আবাদ করে পৃথিবীকে বসবাস উপযোগী করেছেন আমাদের জন্য। আবার খাল-বিল, নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরে রয়েছে মাছের ও জলজ প্রাণীর প্রাচুর্য। পানির তলদেশে রয়েছে মণি-মুক্তাসহ অফুরন্ত রত্নভাণ্ডার। ভূগর্ভে রয়েছে অফুরন্ত পানি ও সোনা-রুপার অমূল্য সম্পদ। এ প্রকৃতি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন।

পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশনা : প্রকৃতিকে আল্লাহ সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন। পাহাড়-নদী, সাগর-মরুভূমি, গাছপালা-খালবিল একেকটার একেক বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য। সবগুলোর সারমর্ম হচ্ছে, মানুষের উপকার করা বা মানুষের উপকারে আসা। এগুলো নষ্ট করা মানে নিজেকে ক্ষতি করা এবং পরিবেশকে দূষিত করা। সুন্দর ও স্বাচ্ছন্দ্যময় সামাজিক পরিবেশ গঠনে খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার থাকা অপরিহার্য। হাদিসে এসেছে, ঈমানের ৭৩টি শাখার সর্বনিম্নটি হলো, রাস্তা থেকে ক্ষতিকারক বস্তু দূর করা। পবিত্রতা ঈমানের অর্ধাংশ। এক বর্ণনায় অভিশপ্ত তিনটি কাজ অর্থাৎ পানির ঘাট, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়াতলে মলত্যাগ থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা এসেছে। অর্থাৎ পানিতে, রাস্তাঘাটে ও ছায়াদার গাছতলে, যেখানে মানুষ বিশ্রাম নেয়, সেখানে মলত্যাগ করে পরিবেশ দূষিত করতে নিষেধ করা হয়েছে। আবার আমরা অনেক সময় হাঁচি-কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢাকি না। এতে নির্গত ময়লা ও জীবাণু দ্বারা অন্যের ক্ষতি হতে পারে। রাসুল (সা.) যখন হাঁচি দিতেন, তখন তিনি মুখ ঢেকে নিতেন। পরিবেশের সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ইসলামে রয়েছে স্বতন্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা। যা অনুসরণ করলে বিশ্বব্যাপী একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং যারা পবিত্র থাকে, তাদেরও।’ (সুরা বাকারা : ২২২)।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ইসলাম : মানুষের অপরিকল্পনা, অদূরদর্শিতা ও অমানবিক কর্মকাণ্ডের কারণে বর্তমানে প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে বায়ুতে দূষণ, তাপমাত্রা, রোগ-বালাই ও প্রাকৃতিক নানান দুর্যোগ বেড়ে চলেছে। তাই এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য মহানবী (সা.) চৌদ্দশ’ বছর আগে বৃক্ষ বা বন রক্ষার প্রতি তাগিদ দিয়েছেন। বৃক্ষ বা শস্য নষ্ট করাকে নিরুৎসাহিত করে তিনি মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন। জনৈক ব্যক্তি একটি গাছের পাতা ছিড়লে রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেকটি পাতা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে।’ গাছপালা, লতাপাতা মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশকে দূষণমুক্ত করে। গাছপালা ঝড়-ঝঞ্ঝা প্রতিরোধ করে এবং মাটির ক্ষয়রোধ করে। এ প্রসঙ্গে আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমান যদি একটি বৃক্ষের চারা রোপণ করে অথবা খেতখামার করে, অতঃপর তা মানুষ, পাখি বা কোনো জন্তু ভক্ষণ করে, তা তার জন্য সদকার সওয়াব হবে।’ (মুসলিম : ৫৫৩২)। পাহাড়-পর্বত রক্ষা করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। আর নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রাখে। তাই আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে পৃথিবীর মানুষকে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশনা দিয়েছেন। এজন্য পরিবেশ ধ্বংসের যে কোনো ধরনের উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে আল্লাহপ্রদত্ত সেবা থেকে বঞ্চিত করার নামান্তর। তাই অকারণে আযৌক্তিকভাবে সৃষ্টিকে কোনো সেবা থেকে বঞ্চিত না করা প্রকৃত মোমিনের পরিচয়। আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক বাসোপযোগী করে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাই আমরা দেখি, প্রচণ্ড শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যেখানে বছরের প্রায় পুরোটা জুড়ে মাঠ-ঘাট, নদী-নালা সর্বত্রই বরফে ঢাকা থাকে, সেখানেও প্রাকৃতিক উদ্ভিদকূল সবুজের ডানা মেলে এবং বরফ আচ্ছাদিত স্থানে স্বাভাবিক জীবন পরিচালনের মাধ্যমে স্রষ্টার অপার মহিমার জানান দেয়। এটাই আল্লাহর শিল্প; যা অকল্পনীয় ও অতুলনীয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত