পাহাড়ি অঞ্চলে বাঁশের সবজি খাওয়ার চল রয়েছে। চীনা খাবারেও উপকরণ হিসেবে কচি বাঁশ ব্যবহারের চল আছে। অনেকে জানেন না, কচি বাঁশ খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনই এর স্বাস্থ্যগুণও প্রচুর। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো থেকে ওজন ঝরার ক্ষেত্রে এ সবজির জুড়ি মেলা ভার। একে অপরকে ক্ষতি করার ক্ষেত্রে অথবা মজা করার ছলে যে শব্দটি সবচেয়ে ব্যবহৃত হয়, সেটিও এই বাঁশ। শুধু সুস্বাদুই নয়, শারীরিক সুস্থতায় বাঁশ খুবই উপকারী। বিভিন্ন রোগ থেকে খুব সহজেই মুক্তি দিতে বাঁশের কার্যকারিতা অপরিসীম। তাইতো চীনারা বাঁশের কোড়লকে ‘স্বাস্থ্যকর খাবারের রাজা’ বলেন। চিনা সভ্যতায় বাঁশ শুভশক্তির প্রতীক। বাড়ির আশপাশে বা ভেতরে বাঁশ রোপণ তাদের ঐতিহ্য। তবে বাঙালিরা বাঁশ নিয়ে খুব সংবেদনশীল। সহজে বাঁশের ধারেকাছে যান না। তবে এই বাঁশ পরিবেশ রক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখছে।
বাঁশ কোনো গাছ নয় : বাঁশ মূলত এক ধরনের ঘাস এবং চির সবুজ বহু বর্ষজীবি উদ্ভিদ; যা নাতিশীতোষ্ণ ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মায়। পৃথিবীতে ৩০০ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সটিটিউট ৩৩ প্রজাতির বাঁশ সংরক্ষণ করেছে। মুলি, তল্লা, আইক্কা ও ছড়ি এদের অন্যতম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাঁশের প্রজাতি ও বৈচিত্র্যের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে। প্রথম স্থানে আছে চীন। চীনের সভ্যতায় বাঁশকে শুভশক্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। এ কারণে চীনা সংস্কৃতির সর্বত্র রয়েছে বাঁশের ব্যবহার। তারা মনে করে, বাঁশ নেগেটিভ এনার্জিকে প্রতিহত করতে পারে।
খাদ্য হিসেবে বাঁশের ব্যবহার : পুষ্টি উপাদান ও মুখরোচক স্বাদের জন্য পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের কাছে খাবার বাঁশ কোড়ল নামে পরিচিত। এর তৈরি স্যুপ, সালাদ, তরকারি বেশ জনপ্রিয়। সাধারণত বাঁশের অঙ্কুরোদগম হওয়ার পর চার থেকে ছয় ইঞ্চি পর্যন্ত যে কচি বাঁশ হয়, সেটাই রান্না করে খাওয়া যায়। আবার বাঁশ পাতা দুধ টাটকা রাখতে এবং চায়ের মধ্যে দিয়েও খাওয়া যায়। পুষ্টিবিদরা জানিয়েছেন, রান্না করা বাঁশে ফাইবার, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, পটাসিয়াম, ভিটামিন ই, আয়রন পাওয়া যায়; যা শরীরকে চাঙ্গা রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ করে। খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে বাঁশ হার্টের জন্য ভালো। ফাইবার থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্যে উপশম দেয় এবং হজমশক্তি বাড়ায়। এটি খাওয়ার পর দীর্ঘক্ষণ ক্ষুধা লাগে না। ফলে ওজন কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। তবে বাঁশ কাঁচা বা বাসি অবস্থায় খাওয়া যায় না। কারণ, এতে পেটে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাঁশের কোড়ল সূর্যালোক থেকে দূরে ঠান্ডা জায়গায় সংরক্ষণ করা হয়। আবার বাঁশের পাতা উত্তম গোখাদ্য।
বাঁশ প্রাকৃতিক এসি : প্রকৃতি-পরিবেশ ও প্রাণ রক্ষায় বিশেষ করে, দুর্যোগ মোকাবিলা, পাহাড় ধস, ভূমি ক্ষয়, নদী ভাঙন রোধসহ জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় বাঁশের ভূমিকা বলে শেষ করা যাবে না। ওয়ার্ল্ড ব্যাম্বু অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, বাঁশ অন্যান্য গাছগাছালির চেয়ে বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করে। আর বেশি মাত্রায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। ফলে বাতাস বিশুদ্ধ থাকে। বলা হয়, বাঁশঝাড় আশপাশের তাপমাত্রাকে চার ডিগ্রি পর্যন্ত ঠান্ডা রাখতে সক্ষম। ফলে এটা অনেকটা প্রাকৃতিক এয়ার কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া তীব্র রোদ থেকে লম্বা লম্বা বাঁশঝাড় ছায়াও দিয়ে রাখে। এ ছাড়া বাঁশ গাছের শেকড় ছড়ানো থাকায় এটি মাটি ভাঙন রোধ করে। মাটির ঢালকে মজবুত করে। ফলে পাহাড় ধস ঠেকানো যায়, ভারী ধাতু শোষণ করে মাটির ক্ষয় রোধ করে, বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আশ্রয় নিতে পারে। এক কথায়, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে বাঁশের গুরুত্ব রয়েছে।
নির্মাণশিল্পে বাঁশের অবদান : বাংলাদেশে বছরে শুকনো বাঁশের চাহিদা অন্তত ১০ লাখ টন। এর মধ্যে নির্মাণকাজে সবচেয়ে বেশি বাঁশের প্রয়োজন। চাহিদা থাকায় চাঁদপুর, সিলেট ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলায় বাঁশের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। বাংলাদেশের গ্রামে উন্নত বাড়িঘর নির্মাণে বাঁশ বেশ টেকসই উপাদান। বিশেষ করে, কাঁচা বাড়ির ভীত দেয়াল ও ছাদ তৈরিতে বাঁশের পাটাতন ও ফ্রেম ব্যবহার হয়। বাঁশের পাতায় ঘরের ছাউনি হয়। আবার পাহাড়ি এলাকায় বাঁশ দিয়েই তোলা হয় মাচার ঘর। গ্রামের লোকজন ছোট খাল পার হতে স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ দিয়ে সেতু বানিয়ে থাকেন। কারণ, অল্প টাকায় এর চেয়ে মজবুত ও টেকসই সেতু গড়া সম্ভব না। বেড়া তুলতে বা বন্যার সময় আশ্রয়ের জন্য মজবুত মাচা তুলতেও বাঁশ লাগে। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকেও বসত-ঘরকে রক্ষা করে বাঁশ। এ কারণে গ্রামে বসতবাড়ির পাশে বাঁশঝাড় দেখা যায়। জাপানে প্রচুর বাঁশের ঘর দেখা যায়। কারণ, এসব ঘর ভূমিকম্প সহনীয়। ভূমিকম্পের সময় বাঁশঝাড়ে আশ্রয় নেওয়া সবচেয়ে নিরাপদ।
বাঁশ দ্বারা নিত্য ব্যবহার্য পণ্য : নিত্য ব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্য- আসবাবপত্র, বাদ্যযন্ত্র, রান্নাঘরের বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন কুলো, ডালা, ঝুড়ি, চাঁটাই, প্লেট, বাটি, চামচ, স্ট্র; সেই সঙ্গে কৃষি সরঞ্জাম, তোরণ, প্যান্ডেল তৈরি, ল্যাম্প, জামা-কাপড়ের হ্যাঙ্গার, ল্যাপটপের কেসিং, ইত্যাদি নানা ধরনের পণ্য বানাতে বাঁশ দরকার হয়। বাঁশের তৈরি হস্তশিল্প পরিবেশবান্ধব, যা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। এগুলো সাধারণত দামে সস্তা হয়, আবার রপ্তানি করে আয়ের সুযোগও থাকে। বাঁশের মধ্যে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ থাকায় এটি এখন শ্যাম্পু, ক্রিমসহ নানা ধরনের প্রসাধনীসহ পোকামাকড় প্রতিরোধকের মতো পণ্য তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে। সুতা ও কাগজ তৈরিতে বাঁশের ব্যবহার অনেক আগ থেকেই হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাঁশের তন্তু দিয়ে টুপি, স্কার্ফ, গ্লাভস, মোজা ও প্যান্ট তৈরি হচ্ছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের কাগজ, টয়লেট পেপার তৈরিতেও ব্যবহার হচ্ছে বাঁশ।
যত্ন ছাড়াই বাঁশের যত উপকার : এত উপকারী এ উদ্ভিদের বিশেষ কোনো যত্নের প্রয়োজন হয় না। এটি যে কোনো পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে মাঝে মধ্যে পানি দিলেই হয়। বাঁশ খুব দ্রুত বড় হয়। চারা রোপণের পর পাঁচ বছরেই পূর্ণাঙ্গ বাগানে পরিণত হয়। বাঁশ গাছ সাধারণত একত্রে গুচ্ছ হিসেবে জন্মায়। একেকটি গুচ্ছে ১০-৮০টি বাঁশ গাছ থাকতে পারে। এসব গুচ্ছকে বাঁশঝাড় বলে। কিছু প্রজাতির বাঁশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৩৬ ইঞ্চি বৃদ্ধি পায়। এর মানে প্রতি ৪০ মিনিটে প্রায় এক ইঞ্চি পরিমাণ বড় হয়। তাই বাঁশ যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। নিয়মিত কেটে পরিষ্কার করতে হবে। দ্রুত বাড়ার কারণে বাঁশঝাড় বিক্রি করে ভালো উপার্জনের সুযোগ থাকে। অনেকে আবার বাড়ির ভেতরের বাতাস বিশুদ্ধ রাখতে বাঁশের চারা লাগিয়ে থাকেন। চাইলে এটি বাগানের মাটিতে রোপণ করা যেতে পারে বা একটি পাত্রে সাজানো যায়। কিছু প্রজাতির বাঁশ গাছ শুধু পানিতে রাখলেই হয়।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক