ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আশুরা ও কারবালার চেতনা

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
আশুরা ও কারবালার চেতনা

আশুরা ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত ঘটনার স্মারক। এ ঘটনায় ইরাকের কারবালা প্রান্তরে যিনি অসম যুদ্ধে অসহায়ভাবে প্রাণ হারান, তিনি ছিলেন রাসুল (সা.)-এর অত্যন্ত স্নেহের নাতি, আলী ও মা ফাতেমার আদরের দুলাল ইমাম হুসাইন (রা.)। এ মর্মান্তিক ঘটনা ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হওয়ার মূলে রয়েছে ইমাম হুসাইনকে শাহাদতের নজরানা পেশ করতে হয়েছিল তার নানাজানের আদর্শ রক্ষার জন্য। যারা তাকে নির্মমভাবে শহিদ করেছে, তারাও ছিল তার নানার আদর্শের দাবিদার মুসলমান। নবীজির ইন্তেকালের মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তার নাতি মজলুমভাবে শহিদ হওয়া মানুষের বিবেক কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। এ কারণে যুগে যুগে কারবালা মানবহৃদয়ে শোকের মাতম তুলেছে। আর সেসব হৃদয়কে এখনও কাঁদায়, যারা প্রত্যেক নামাজের শেষ বৈঠকে দরুদ পড়ে আলে মুহাম্মদ বা আহলে বাইতের প্রতি দরুদ ও সালাম জানায়।

হিজরতের পর নবী করিম (সা.) ১০ বছর মদিনাকেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনার পর দশম হিজরিতে ইন্তেকাল করেন। এরপর খোলাফায়ে রাশেদিনের চারজন সত্যনিষ্ঠ খলিফা দীর্ঘ ৩০ বছর আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সঠিক নীতি-আদর্শের ওপর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তৃতীয় খলিফা ওসমান (রা.) বিদ্রোহীদের হাতে শাহাদত বরণ করলে তার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার দাবিতে সিরিয়ার গভর্নর আমীর মুআবিয়া (রা.) চতুর্থ খলিফা আলী (রা.)-এর সঙ্গে বিরোধ ও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। আলী (রা.) খারেজি আততায়ীর হাতে শাহাদত বরণের পর তার ছেলে ইমাম হাসানকে খলিফার পদে নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু তিনি আমির মুয়াবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে সেনাবাহিনীর বিশৃঙ্খলা ও মুসলিম উম্মাহর অব্যাহত অনৈক্যের কথা চিন্তা করে খেলাফতের দাবি ত্যাগ করেন। এরপর ৬০ হিজরি পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর আমির মুআবিয়া (রা.) ইসলামি জাহান শাসন করেন। ৫৫ হিজরিতে পূর্ববর্তী খলিফাদের নিয়ম ভেঙে স্বীয় পুত্র ইয়াজিদকে তিনি খলিফা মনোনীত ও জনগণের বাইআত আদায় করেন।

পিতার ইন্তেকালের পর ৬০ হিজরিতে ইয়াজিদ দামেস্ককেন্দ্রিক ইসলামি রাষ্ট্রের খলিফার পদে বসে। এরপরই মদিনার গভর্নরের কাছে পত্র লিখে, যাতে তার পক্ষে হুসাইন (রা.)-এর বাইআত আদায় করা হয়। রাসুলের নাতি হয়ে হুসাইন (রা.)-একজন অপদার্থ ও ইসলামি শরিয়তের রীতি-নীতির প্রতি প্রকাশ্যে বিরুদ্ধাচরণকারী খলিফার হাতে বাইআত বা আনুগত্যের শপথ নিতে পারেন না। তাই হিজরি ৬০ সালের রজব মাসে রাতের অন্ধকারে তিনি মদিনা থেকে সপরিবারে মক্কায় চলে আসেন। ইয়াজিদের প্রতি বিদ্রোহী ছিল কুফার জনগণের মন। কুফা বর্তমান ইরাকের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত। চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) যখন মদিনায় খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে সপরিবারে কুফায় চলে যান। কারণ, কুফার লোকেরা ছিল আলী (রা.)-এর সমর্থক ও অনুরক্ত। ইমাম হাসান (রা.) খেলাফতের দাবি ত্যাগ ও পরে বিষপ্রয়োগে শাহাদত বরণ করলে ইমাম হুসাইন (রা.) আহলে বাইতের সদস্যদের নিয়ে মদিনায় চলে আসেন। কাজেই কুফার লোকেরা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পূর্বপরিচিত ছিল এবং কুফাবাসীও হুসাইন (রা.)-কে ভালোভাবে চিনত। ইয়াজিদ দামেস্কে খেলাফতের মসনদে বসার পর হুসাইন (রা.) মক্কায় চলে যাওয়ার সংবাদ পেয়ে কুফার গণ্যমান্য লোকেরা একের পর এক চিঠি পাঠাতে থাকে হুসাইনের কাছে। সবার বক্তব্য ছিল, আমরা কিছুতেই ইয়াজিদের মতো অপদার্থের হাতে বাইআত নেব না। আপনি আমাদের মাঝে চলে আসুন। আমরা আপনার হাতে বাইআত গ্রহণ করে প্রয়োজনে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব।

রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলকদ- এ পাঁচ মাস হুসাইন (রা.) বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন। সবার সঙ্গে পরামর্শ করেন। অধিকাংশ লোকের পরামর্শ ছিল, কুফার লোকেরা বিশ্বাসঘাতক। কাজেই আপনি যাবেন না। তিনি দেখেন যে, ইয়াজিদ নাছোড়বান্দা। প্রয়োজনে মক্কা আক্রমণ করবে। তখন কাবাঘর ও মক্কা নগরীর পবিত্রতা লুণ্ঠিত হবে। ‘আমার কারণে মক্কার অমর্যাদা হোক’ তা হুসাইন (রা.) সহ্য করতে পারেন না। তাই সুচিন্তিতভাবে কুফায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি মাহে রমজান ও হজের মৌসুমে মানুষকে ইসলামি খেলাফত বিপথগামী হওয়ার ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেন। ওদিকে সর্বশেষ পরিস্থিতি যাচাই করার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকিল পত্রযোগে জানান, এ পর্যন্ত কুফার ১৮ হাজার মানুষ আপনার পক্ষে আমার হাতে বাইআত গ্রহণ করেছে। কাজেই আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারেন।

ইসলামি খেলাফতের মর্যাদা ও তা রক্ষার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রার যে দিনটি নির্ধারণ করেন, তা ছিল ৮ জিলহজ। যেদিন হাজিরা ইহরাম পরে মক্কা থেকে মিনা ও আরাফাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ওই দিনই তিনি মক্কা থেকে রওনা হয়ে পথিমধ্যে জানতে পারেন, কুফাবাসী বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নতুন গভর্নর ইবনে যিয়াদের ষড়যন্ত্রের শরিক হয়ে মুসলিম ইবনে আকিলকে হত্যা করেছে। এ সংবাদে যার পর না-ই মর্মাহত হয়ে একবার মক্কায় ফিরে যাওয়ার মনস্থ করেন; কিন্তু সফরসঙ্গী মুসলিম ইবনে আকিলের ছেলেরা পিতার রক্তের দাম নেওয়ার যে সংকল্প দেখায়, তাতে তিনি সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই হুর ইবনে ইয়াজিদের নেতৃত্বে কুফার গভর্নরের প্রেরিত বাহিনী অন্য কোথাও যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। কারবালা প্রান্তরে উপনীত হতে বাধ্য করে। ইতিহাসের বিম্ময়কর তথ্য হলো, পথিমধ্যে নামাজের সময় হলে পথরোধকারীরাও ইমাম হুসাইন (রা.)-এর ইমামতিতে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষ হলে আবার তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে। এভাবে কুফার সামরিক অধিনায়ক হুর ইবনে ইয়াজিদ হিজরি নববর্ষ ৬১ সালের মহররম মাসে ইমাম ও তার পরিবারকে কারবালায় গিয়ে শিবির স্থাপনে বাধ্য করে।

কুফার গভর্নর দামেস্ক অধিপতি ইয়াজিদের নির্দেশে ইমাম হুসাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ২২ হাজার বা ৩০ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী গঠন করে। মুহাম্মদ ইবনে সাদেককে সে বাহিনীর অধিনায়ক নিযুক্ত করে। তিনি ছিলেন কাদেসিয়া বিজয়ী সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর ছেলে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তাকে সেই অঞ্চলের শাসকের পদ প্রদানের লোভ দেখিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইমাম হুসাইন (রা.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠায়। দুনিয়ার সামান্য স্বার্থের লোভে তিনি এত বড় ঝুঁকি মাথায় নেন। শেষ পর্যন্ত কারবালা প্রান্তরে শান্তি স্থাপনের জন্য যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইমাম শিবিরের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়। চরম মুহূর্তে সেনাপতি হুর ইবনে ইয়াজিদ ইমামের শিবিরে পালিয়ে আসে। পরে ইমামের পক্ষ নিয়ে বীরবিক্রমে লড়াই করে শাহাদতের পেয়ালা পান করেন। যা প্রমাণ করে, ইমাম ছিলেন সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত; আর ইয়াজিদ ও ইবনে যিয়াদের বাহিনী যুদ্ধ করেছিল মিথ্যার পক্ষে।

আশুরা এলে আমরা বলি, ‘ইমাম হুসাইন (রা.) অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন’। এ নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সেই ন্যায় ও সত্য কি ছিল, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। যার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ইমাম হুসাইন (রা.)। বস্তুত সে সত্য ও ন্যায় ছিল রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামি নেতৃত্ব। ইসলামি খেলাফতের আসনে ইয়াজিদের মতো পাপিষ্ঠকে কোনো মুসলমান মেনে নিতে বা সমর্থন করতে পারে না- ইমাম হুসাইন (রা.) নিজের জীবন দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত ধর্ম ও রাজনীতি ইসলামের দুটি হাত বা পা। একটি অচল হলে অপরটি অকেজো হয়ে যায়। কাজেই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কোনো পাপাচারীর হাতে তুলে দিয়ে ধর্ম-কর্ম নিয়ে বুজুর্গ হয়ে বসে থাকার সুযোগ আল্লাহর রাসুলের নাতি উম্মতের জন্য রাখেননি।

একশ্রেণির কলুষিত মনের লোক মানুষকে বোকা বানানোর জন্য বলে, ইমাম হুসাইন (রা.) পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। তার মানে কারবালার ঘটনা একটি রাজনৈতিক দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কিন্তু আমরা যখন দেখব, ইয়াজিদের হাতে বাইআত এড়ানোর জন্য ইমাম হুসাইন (রা.) মদিনার বাড়িঘর ত্যাগ করে মক্কায় চলে এসেছেন। রাসুলের নাতি হিসেবে মক্কায় সর্বোচ্চ ধর্মীয় মর্যাদার মধ্যে দীর্ঘ পাঁচ মাস শলা-পরামর্শ করেছেন। আমরা দেখি, সবাই হজে আরাফার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার দিন তিনি কুফা যাত্রার জন্য বেছে নিয়েছেন। এর আগে পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফায় প্রেরণ করেছেন। পথিমধ্যে শত্রু বাহিনীর সঙ্গে বহুবার বৈঠক ও মতবিনিময় করে শান্তি স্থাপন ও যুদ্ধ এড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আশুরার আগের রাতে সঙ্গীদের ডেকে অন্ধকারের ঢাল ব্যবহার করে নিজ নিজ গন্তব্যে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ মৃত্যু আসন্ন জেনেও ইমামকে ছেড়ে যেতে তারা কেউ রাজি হয়নি। আশুরার দিন তিনি সেনাপতির ন্যায় শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যুহ রচনা করেন। আক্রান্ত হলে একে একে সঙ্গী যোদ্ধাদের রণাঙ্গনে পাঠানোর পর নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন। এর মধ্যে এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি বা তার এমন কোনো আচরণ প্রকাশ পায়নি, যা রাসুল (সা.)-এর আদর্শের বাইরে বলে প্রতীয়মান হতে পারে। কাজেই চিন্তা করলে বোঝা যাবে, ইমাম হুসাইন (রা.) অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে নানাজানের দ্বীন রক্ষার জন্য শাহাদতের পথ বেছে নিয়েছিলেন।

বিদ্বেষী শ্রেণিটি ইবনে যিয়াদের ওপর দোষ চাপিয়ে ইয়াজিদকে ভারমুক্ত করার জন্যও একধরনের প্রচারণা চালায়। অথচ ইতিহাস সম্পর্কে যাদের সামান্য লেখাপড়া আছে, তার জানেন, ইয়াজিদ ক্ষমতায় আরোহণের পর প্রথম বছর কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটায়। দ্বিতীয় বছর মদিনা আক্রমণ করে তিনদিন পর্যন্ত মদিনায় গণহত্যা চালায়। মসজিদে নববিকে ঘোড়ার আস্তাবলে পরিণত করে। আর তৃতীয় বছর যখন কাবাঘরে আশ্রিত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রা.)-কে হত্যার জন্য সিরীয় সৈন্যরা কাবাঘর লক্ষ্য করে অগ্নিগোলা নিক্ষেপ করছিল, তখনই দামেস্ক থেকে ইয়াজিদের মৃত্যুর সংবাদ আসে। আর তারা ফিরে যায়। কাজেই এমন পাপাচারীর পক্ষ নেওয়ার সুযোগ কোনো সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের নেই।

ইমাম হুসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে অসহায়ভাবে শহিদ হয়েছিলেন আর দৃশ্যত ইয়াজিদ বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে ইমাম হুসাইন (রা.) সেদিন বিজয়ী হয়েছিলেন। যার কারণে বিশ্বের ঘরে ঘরে আজ হাসান ও হুসাইন নামের এত আদর ও কদর। পক্ষান্তরে কোনো মানুষই নিজের সন্তানের নাম ইয়াজিদ রাখতে রাজি নন। ইতিহাস সাক্ষী, কুফাবাসী তাদের বিশ্বাসঘাতকতার চরম প্রায়শ্চিত্ত পরবর্তী মুখতারের আন্দোলনে ভোগ করেছিল। সে আন্দোলনে কারাবালায় অংশগ্রহণকারীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছিল। রাসুল (সা.)-এর নাতি হয়েও ইসলামের জন্য এত বড় আত্মত্যাগ প্রমাণ করে, ইসলাম মানে বিলাসিতা ও আরামদায়ক জীবনে সন্তুষ্ট থাকা নয়; ইসলাম মানে ত্যাগের পরাকাষ্ঠা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত