ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ

পশু-পাখির স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা আজ বিঘ্নিত। এদের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন। কালের বিবর্তনে জনবিস্ফোরণে জীবনের তাগিদে কুঠারের আঘাত পড়ল সবুজ অরণ্যে। বনজঙ্গল সাফ করে মানুষ গড়ে তুলল বসতি, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, শহর-বন্দর-নগর, লোকালয় ও কল-কারখানা। ফলে এ যান্ত্রিক সভ্যতার যন্ত্রণায় আর পাখির কিচিরমিচির, কুহু-কেকার কলকাকলিতে আমাদের ঘুম ভাঙে না। ঘুম ভাঙে যানবাহন ও কল-কারখানার ঘর্ঘর, ঝনঝন শব্দে। হারিয়ে গেছে সেসব সোনালি দিন, যখন বাড়ির আঙিনায় গাছে পাতার আড়ালে নেচে নেচে ফুরফুর করে বেড়াত দোয়েল-কোয়েল-বুলবুলি। বাড়ি-বাড়ি আমণ্ডজাম, পেঁপে-কলা ও কাঁঠালের বাগান আর নেই। নেই পুকুরপাড়ে, ঝোঁপঝাড়ে, বাঁশবাগানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর রাতের আঁধারে পদ্মদীঘিতে শতসহস্র জোনাকির খেলা। এসব শুধুই স্মৃতি। তাই বন ও বন্য প্রাণীদের নিয়ে এতদিন যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় ছিল, তা আজ ধ্বংসের মুখে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ আজ ভারসাম্যহীন : জনবিস্ফোরণে আজকাল অরণ্যের মূলভিত্তি গাছপালা উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে বন-বনানী। অপ্রতিরোধ্য গতিতে কল-কারখানা গড়ে উঠছে। নিশ্চিহ্ন হচ্ছে পাখণ্ডপাখালি, জন্তু-জানোয়ার। জনসংখ্যা ও জনবসতি বৃদ্ধির ফলে সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাহিদাজনিত চাপ পড়ছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ও কর্মসংস্থান ইত্যাদির পরিমাণ বর্ধিত জনসংখ্যার চেয়ে কম হওয়ায় চাষের তীব্রতা, কৃত্রিম সার ও কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ক্রমাগত বিনষ্ট হচ্ছে চাষযোগ্য জমির সঞ্জিবনী শক্তি। নতুন নতুন বসতি আর কল-কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে চাষযোগ্য জমি ও বনভূমি। শিল্পজাত দ্রব্য ও পণ্য উৎপাদন তৈরির কারখানার কালো ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস ও বর্জ্য নির্গমনের পাশাপাশি রাসায়নিক শিল্পাঞ্চল থেকে প্রতিদিন নদী, হ্রদ ও জলাশয়ে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত বর্জদ্রব্য মিশে উদ্ভিদ, মাটি, পানি, বাতাস ও প্রাণিজগতের ওপর বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ হয়ে উঠছে ভারসাম্যহীন, দূষিত ও বসবাসের অযোগ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে মুক্তাঞ্চল ও বনভূমির পরিমাণ অতি দ্রুত সীমিত হচ্ছে। জলাভূমি ভরাট করে আবাসস্থল-স্থাপনা ইত্যাদি নির্মিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এতে জলাধার, জলভ উদ্ভিদ ও জলজপ্রাণী বিঘ্নিত ও নিঃশেষ হচ্ছে। ফলে মাছে-ভাতে বাঙালির মূল খাদ্য উপাদানে দিন দিন প্রচুর ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিশ্ব-পরিবেশ এখন হুমকির মুখে : ঘর নির্মাণ, শিল্প-কারখানার কাঁচামাল ও জ্বালানি কাঠের প্রয়োজনে প্রতিদিন উজাড় করা হচ্ছে বনভূমি। জ্বালানি হিসেবে কাঠ-কয়লার প্রয়োজনে অনেক সময় অবৈধভাবে বনভূমিতে আগুন ধরিয়ে সংগ্রহ করছে কাঠ-কয়লা। এ প্রেক্ষাপটে এসব উপযোগের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রতিদিনই কমে যাচ্ছে মুক্ত ভূমি ও বনাঞ্চল। ভারসাম্যমূলক প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে সরকারি হিসেবমতে বনভূমির পরিমাণ ১৬ শতাংশ ধরা থাকলেও বাস্তবে আছে ৯ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে প্রতিবছর বন উজাড় হচ্ছে ৯.৪ শতাংশ। পাহাড় কেটে বসতবাড়ি তৈরিতে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। শহরের ভাসমান জনগোষ্ঠীর কারণে এবং বিপুলসংখ্যক বস্তিবাসীর চাপেও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ফলে ভূমি-ক্ষয়ের মাত্রা বাড়ছে। বনাঞ্চল ও ফসলী জমি কমছে। দেশের গড় তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিশ্ব গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতে, বিশ্বের বনভূমি উজাড় হতে হতে প্রায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে বিশ্ব-পরিবেশ এখন হুমকির মুখে। বসবাসের উপযোগী ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবীর অস্তিত্বের প্রয়োজনে গাছপালা-বৃক্ষরাজি অপরিহার্য। বন-বনানীসমৃদ্ধ বৃক্ষসমূহ শুধু নিসর্গ প্রকৃতির শোভাবর্ধকই নয়, বরং জীববৈচিত্র্যে অপরিহার্য অংশ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনে বৃক্ষরাজির এ অনিবার্য ভূমিকা এমনই যে, বৃক্ষহীন পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করা অসম্ভব। অক্সিজেন দিয়ে গাছপালা কেবল জীবনই রক্ষা করে না, প্রাকৃতিক ও জাগতিক ভারসাম্য রক্ষায় অভাবনীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

মানুষ প্রকৃতির সন্তান : প্রকৃতির মাঝে আমাদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের মূল স্বত্বা ও অস্তিত্বের সঙ্গে প্রকৃতি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। সুতরাং যে কোনো মূল্যে প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। বর্তমান বিশ্বে নগরায়ন ও শিল্পায়ন সমৃদ্ধ দেশসমূহের বিষাক্ত শিল্পবর্জ্য ও বিষাক্ত গ্যাস এবং দূষিত বায়ুদূষণের বিষক্রিয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশ ক্রমশ ধ্বংসের দিকে ধাবিত। প্রকৃতি ও সমাজযন্ত্রকে শোষণ না করে, প্রকৃতিকে তার স্বরূপ রেখে উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও মানবতার বিকাশ তথা মানবিকতার মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে যাওয়াই স্বচ্ছতা, দেশপ্রেমের নিবেদিত স্বাধীনতার মূল্যবোধ ও প্রগতির মূলভিত্তি। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান মানুষ ও অন্যান্য সৃষ্টিজীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। এগুলোর বিনাশ বা ক্ষতি সাধন করা হলে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়। অথচ ইসলাম তার অনুসারীদের সামগ্রিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত দেখতে চায়। তাই স্বাস্থ্যসম্মত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং উন্নত জীবনমান পদ্ধতি একে অপরের পরিপূরক। পৃথিবীর মানুষকে গাছপালা ও পাহাড়-পর্বত ধ্বংস না করার জন্য সতর্কবাণী দিয়ে পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। এরপর তা (বায়ু) মেঘমালাকে সঞ্চালিত করে। অতঃপর তিনি (আল্লাহ) মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তাকে (মেঘমালাকে) স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বৃষ্টিধারা নির্গত হয়। তিনি (আল্লাহ) তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা তা (বৃষ্টি) পৌঁছান; তখন তারা আনন্দিত হয়।’ (সুরা রুম : ৩৮)।

পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব : ইসলামে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব অপরিসীম। যেখানে-সেখানে উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা, কফ, থুথু ও মলত্যাগে পরিবেশ দূষিত হয়ে স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করে। নোংরা ও দূষণমুক্ত পরিবেশ রোগব্যাধির প্রধান কারণ। তাই এসব দূষণযুক্ত পরিবেশের কবল থেকে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখলে মারাত্মক ও সংক্রামক রোগব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে এসব নোংরা পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার ওপরই নির্ভর করে জনস্বাস্থ্যের সফলতা। তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা ও দূষণ প্রতিরোধে সবার যথোচিত দায়িত্ব পালন করা উচিত। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা নিক্ষেপ ও রুচিহীনতা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। অথচ ইসলাম এটাকে নিষিদ্ধ করেছে। সুস্থতা, সৌন্দর্য, মননশীলতা, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির কথা বলে ইসলাম। সুতরাং ময়লা-আবর্জনা দিয়ে পরিবেশ দূষিত করা ঠিক নয়। প্রিয় নবী (সা.) সাবধান করে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের আঙিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখ।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)। ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ (মুসলিম : ২২৩)।

মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রয়োজন : সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য চাই সুস্থ মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। অনুকূল ও সুন্দর পরিবেশ ছাড়া কোনো জীবের অস্তিত্ব দীর্ঘ হতে পারে না। বনভূমি ও বন্য পশুপাখি আল্লাহতায়ালার দান ও প্রকৃতির শোভাবর্ধক। রাসুল (সা.) প্রকৃতি-পরিবেশ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা আরোপ করেছেন। তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ-সুন্দর জীবনযাপনের জন্য অবশ্যই ইসলামের আলোকে পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন করা বাঞ্ছনীয়। পরিবেশ সংরক্ষণ ও তাপমাত্রা কমানোর জন্য বন-জঙ্গল ও গাছপালা অতীব প্রয়োজনীয়; যা মানুষ নির্বিচারে ধ্বংসে মেতেছে। অথচ প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে ইসলামের আরেকটি মৌলিক নীতি হলো, প্রকৃতির অন্যান্য সৃষ্টির কোনোরূপ ধ্বংস, বিনাশ, অপচয় বা অপব্যবহার করা যাবে না। প্রত্যেকটি সৃষ্টি কোনো না কোনোভাবে মানুষ অথবা অন্য কোনো সৃষ্টিকে সেবা দান করে। পরিবেশ ধ্বংসের যে কোনো ধরনের উদ্যোগ বা চেষ্টা মানুষসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে আল্লাহর দেওয়া সেবা থেকে বঞ্চিত করার শামিল। বিনা প্রয়োজনে অযৌক্তিকভাবে কোনো সেবা থেকে বঞ্চিত করার কোনো নৈতিক অধিকার মানবজাতিকে প্রদান করা হয়নি। প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়, বিনাশ অথবা অপরিমিত ব্যবহার কোনোটিই ইসলামের দৃষ্টিতে সমর্থনযোগ্য নয়। ইসলাম পরিবেশ সংকটের অবসান প্রত্যাশা করে। কেননা, পরিবেশ সংকট উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ইসলাম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বস্তুগত ও আত্মিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্বারোপ করে। পরিবেশ সুরক্ষায় গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধ বহুলাংশে সহায়ক।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত