সেভ টাইগার সেভ বেঙ্গল
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এশিয়ার মাত্র কয়েকটি দেশের বন-জঙ্গলে বাঘের বসবাস। বাংলাদেশ ও ভারতের কোলঘেঁষা সুন্দরবনেও আছে বাঘের আনাগোনা। প্রাণিবিদরা এ বাঘকে বিড়াল জাতীয় বা ক্যাট গ্রুপের প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। একসময় পৃথিবীতে বাঘের নয়টি উপ-প্রজাতি ছিল। কিন্তু আজ থেকে প্রায় দেড়শ’ বা দুইশ’ বছর আগে তিনটি প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। পৃথিবীতে এখন টিকে রয়েছে মাত্র ছয়টি উপ-প্রজাতির বাঘ। তবে আকৃতি ও সৌন্দর্যে যেসব বাঘ খ্যাতিমান, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে সুন্দরবনের বাঘ, অর্থাৎ বেঙ্গল টাইগার অন্যতম। এ বাঘের বৈজ্ঞানিক নাম ‘প্যান্থেরা টাইগ্রিস’। সুন্দরবনের এ বেঙ্গল টাইগারকে যা দিয়ে চেনেন সবাই, সেই ডোরাকাটা বাঘের জ্ঞাতিভাইও রয়েছে।
বেঙ্গল টাইগারের দেহ : প্রাণিবিদদের মতে, সুন্দরবনের বাঘ চেনার অন্যতম প্রধান নিয়ামক হলো এদের দেহের আকার। বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবনের বাঘ বিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের দেহের আকৃতি ছোট করে ম্যানগ্রোভ বনে টিকে থাকার মতো শারীরিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। সারা পৃথিবীতে বাঘের যত উপ-প্রজাতি রয়েছে, সবগুলোর চেয়ে সুন্দরবনের বাঘ ছোট। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ্য, সুন্দরবন ছাড়াও ভারত, ভুটান, নেপাল এবং মিয়ানমারেও বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়। সেগুলোর সঙ্গে সুন্দরবনের বাঘের একমাত্র পার্থক্য হলো দেহের আকার। এ আকার ছাড়া সুন্দরবনের বেঙ্গল টাইগার ও পৃথিবীর অন্য জায়গার বেঙ্গল টাইগারের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
বেঙ্গল টাইগারের ওজন : সুন্দরবনের বাঘের দেহের আকার যেমন ছোট, তেমনি এ বনের বাঘের ওজনও কম। সুমাত্রান মেয়ে বাঘের ওজন সাধারণত গড়ে ৮৫ থেকে ৯০ কিলোগ্রাম হয়। কিন্তু সুন্দরবনের মেয়ে বাঘের গড় ওজন ৭৫ থেকে ৮০ কিলোগ্রাম। তবে সুন্দরবন ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেসব বেঙ্গল টাইগার পাওয়া যায়, সেখানকার মেয়ে বাঘের ওজন গড়ে ১৩৫ থেকে ১৪০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। বেঙ্গল টাইগারের ওজন কম। অন্য জায়গার বেঙ্গল টাইগার কিছুটা বড়। একই বাঘ; কিন্তু সুন্দরবনে যেটা রয়েছে, সেটার আকৃতি অন্য জায়গার বেঙ্গল টাইগারের চেয়ে একটু ছোট।
বেঙ্গল টাইগারের বিচরণভূমি : বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিস্তৃত দশ হাজার বর্গকিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ এর ৬০ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। সুন্দরবনজুড়ে খাল-বিল, নদী, শ্বাসমূল থাকায় বাঘের চলাচলের জন্য তা কিছুটা অসুবিধাজনক। সেই সঙ্গে এখানে খাবারের স্বল্পতা রয়েছে। এসব কারণে সেখানে একেকটি বেঙ্গল টাইগারের বিচরণভূমি ১৫ থেকে ২০ বর্গকিলোমিটার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার এটি ৩০ থেকে ৪০ বর্গকিলোমিটারও হতে দেখা যায়। কিন্তু সুন্দরবন বাদে অন্যান্য অঞ্চলের বেঙ্গল টাইগারকে সাধারণত ৬০ থেকে ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিচরণ করতে দেখা যায়। বেঙ্গল টাইগারের বাইরে যেসব বাঘ, তাদের একেকটির বিচরণভূমি একেক রকম। যেমন- সাইবেরিয়ান বাঘের বিচরণভূমি বেশি। কারণ, সাইবেরিয়াতে জায়গার অভাব নেই। সেখানকার একটা বাঘের বিচরণভূমি ৫০০ থেকে ১০০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
বাঘের গায়ের রং : বেঙ্গল টাইগারের গায়ের রং হলুদ থেকে হালকা কমলা রঙের হয়। এদের ডোরার রং হয় গাঢ় খয়েরি থেকে কালো রঙের। এ বাঘের পেটের রং সাদা। আর লেজ হলো কালো কালো আংটিযুক্ত সাদা রঙের। তবে পৃথিবীতে সাদা বাঘও আছে। তাদের শরীরের ওপর গাঢ় খয়েরি কিংবা উজ্জ্বল গাঢ় রঙের ডোরা থাকে। কিছু কিছু অংশ শুধুই সাদা। বেঙ্গল টাইগারকে চিহ্নিত করার সবচেয়ে প্রধান উপায় হলো, এদের গায়ের ডোরা। পৃথিবীতে যত বাঘ আছে, তাদের একটির ডোরার সঙ্গে অন্যটির ডোরার মিল নেই। বাঘের স্ট্রাইপ দেখে বোঝা যায়, এটা ক বাঘ, এটা খ বাঘ, এটা গ বাঘ। সারা পৃথিবীতে যত বাঘ আছে, প্রত্যেকের স্ট্রাইপ ভিন্ন। এটা মানুষের ফিঙ্গার প্রিন্টের মতো।
বাংলার বাঘ চেনার উপায় : বাঘ ভালো সাঁতার কাটলেও সে প্রয়োজন ছাড়া কখনও সাঁতরে নদী পার হয় না। সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে রায়মঙ্গল নদীটা বাংলাদেশ ও ভারতের সুন্দরবনকে আলাদা করেছে। ওই নদীটা বড়; কিন্তু অকারণে বাঘ তিন কিলোমিটার সাঁতার কাটবে না। তাহলে একটা বাঘ কোন কোন পরিস্থিতিতে সাঁতার কাটবে? কোনো বাঘ যদি তার টেরিটোরি হারিয়ে ফেলে, তাহলে সে সাঁতার কেটে ওপাড় যেতে পারে। একটা পুরুষ বাঘের সঙ্গে তিন থেকে চারটি নারী বাঘ থাকতে দেখা যায়। কোনো বাঘ যখন তার টেরিটোরিতে সঙ্গী না পায়, তখন সে সাঁতরে চলে যায়। খাবারের সন্ধানেও বাঘেরা নদী পারাপার হয়। তবে কোনো বাঘ যদি একপাশ থেকে আরেক পাশে আসে, তাহলে তা জরিপের সময় উঠে আসে। অনেকে বলেছেন, রায়মঙ্গল পেরিয়ে ওপাশে যায় না বা ওপাড় থেকে আসে না যে, তা নয়। কিন্তু যদি কোনো বাঘ আসে, তাহলে জরিপের সময় সেটা টের পাওয়া যাবে। স্ট্রাইপ দেখে বোঝা যাবে, সে নতুন বাঘ। রায়মঙ্গলের কাছে হলদিবুনিয়া দ্বীপ বনাঞ্চলের সঙ্গে ভারতের সুন্দরবনের ৭০০-৮০০ মিটার তফাৎ। সেখানে একটা ছোট্ট নদী আছে। এ নদীর প্রস্থ মাত্র ৮০০ মিটার। এখান দিয়ে বাঘ নিয়মিত পার হয়। বাঘের কোনো দেশ নেই।
বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা : বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বাঘশুমারি হয় ২০০৪ সালে। তখন বন বিভাগ ও ইউএনডিপি যৌথভাবে সুন্দরবনে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে একটি জরিপ করে। সেই জরিপে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ৪৪০টি। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানীদের কাছে সেই জরিপটি বিজ্ঞানসম্মত না হওয়ায় ২০১৫ সালে সর্বপ্রথম ক্যামেরা ফাঁদ ব্যবহার করে বাঘের ছবি তুলে ও পায়ের ছাপ গণনা করে বাঘের ওপর জরিপ চালানো হয়। সেই জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে বাঘ আছে ১০৬টি। ২০১৮ সালের আরেকটি জরিপে দেখা যায়, বাঘের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১১৪টি। এটিই এ পর্যন্ত করা সর্বশেষ জরিপ। ভারতের সুন্দরবনেও প্রায় ১০০ বাঘ রয়েছে। তবে বর্তমানে সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় আরও একটি জরিপ চলমান রয়েছে। গত বছর জানুয়ারি মাসে এ জরিপটি শুরু হয়েছিলো। যা এ বছর মে মাস নাগাদ শেষ হবে। সে ক্ষেত্রে বছরের মাঝামাঝি সময়ে জরিপের চূড়ান্ত ফলাফল হাতে আসবে বলে জানায় বন বিভাগ। তবে এ জরিপ সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, এ বছর জরিপে বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে।
বাঘের সংখ্যা বাড়ার কারণ : প্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাঘের সংখ্যা বাড়ার মূল কারণ হলো মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি। সমাজে কেউ বাঘ বা হরিণ শিকার করলে তাকে এখন অনেকেই ভালো চোখে দেখে না। এটা একটি কারণ। সুন্দরবনের আশপাশে ৭৬টি গ্রাম আছে। সেগুলোর ৮০ শতাংশ গ্রামে এখন ‘ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম’ আছে।
এ ছাড়া একটা সময় সুন্দরবন মানেই ছিল জলদস্যু ও বনদস্যুদের আখড়া। এখন সেটা আর নেই। ২০১৮ সাল থেকে বনদস্যু ও জলদস্যু নাই হয়ে গেছে। বাঘ ও হরিণ বৃদ্ধির মূল কারণ এটাই। যখন দস্যুরা সুন্দরবনে থাকত, তাদের খাওয়ার একমাত্র জিনিস হলো হরিণের মাংস। বর্তমানে হরিণের সংখ্যা এক লাখ ৪৮ হাজার। হরিণের সংখ্যা বাড়লে বাঘ বাড়বে। কারণ, হরিণ বাঘের প্রধান খাবার। খাবার থাকলে মানুষের ক্ষেত্রে যেমন হয়, বাঘের ক্ষেত্রেও তাই হবে। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে এটা নিয়মের মাঝে চলে। হরিণ বাড়লে বাঘ বাড়ে। আর বাঘ বাড়লে হরিণ কমবে। হরিণ বাড়লে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ায় বাঘ বনের বাইরে কম আসবে।
বাঘের সংখ্যা বাড়লে বিপদ : অনেকে মনে করছেন, বন বিভাগ ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ায় হরিণ ও বাঘের সংখ্যা ক্রমশ বাড়বে। সেই সঙ্গে আগামী দশ বছরের মাঝে বাঘ ও হরিণ একটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাদের মতে, তখন বাঘ-মানুষের সংঘর্ষ বাড়বে। কারণ, বনে যদি বাঘের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, তাহলে তারা সেই অনুযায়ী খাবার পাবে না। আর খাবার না পেলে তারা লোকালয়ে প্রবেশ করবে। গ্রামে বাঘ-মানুষের সংঘর্য বাড়বে। এটা সারা দুনিয়ায় আছে। ক্যান্সারকে যেমন ম্যানেজমেন্টে রাখতে হবে, বাঘ মানুষের সংঘর্ষও তাই। দুনিয়ায় মানুষ বেড়েছে, বনের ওপর চাপ বাড়ছে। বনের আশপাশে মানুষের ঘরবাড়ি আছে। স্বাভাবিকভাবেই এ দ্বন্দ্ব থাকবে। কিন্তু এটাকে সহনশীল রাখাই মূল লক্ষ্য।
তবু বাঘ কেন গুরুত্বপূর্ণ : প্রায় দুইশ’ বছর আগে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে বাঘের দুটি উপপ্রজাতি হারিয়ে গিয়েছিল। আরেকটা হারিয়েছিল রাশিয়ার ওই অঞ্চল থেকে। তখন এ তিন উপপ্রজাতি হারিয়েছিল। কারণ, মানুষ তখন বাঘকে হিংস্র মনে করে মেরে ফেলত। নিজেদের জীবন নির্বিঘ্ন করতে তারা প্রাণী মারত। তখন ইকোলজি, পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা মানুষের ধ্যান-ধারণায় ছিল না। আজকের বালিদ্বীপের সব বাঘ মেরে ফেলা হয়েছিল শুধু নিরাপদ বসবাসের জন্য। কিন্তু পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য বাঘ প্রয়োজন। ইকোসিস্টেম ফাংশনাল থাকলে সেখান থেকে যে ইন্ডিরেক্ট সার্ভিস তথা মাছ, নির্মল বায়ু, মধু, পাই, যদি সিস্টেম ধ্বংস হয়ে যায়, তখন তা পাওয়া যায় না। এ পপুলেশন যদি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়, এটিকে রিপ্লেস করা সম্ভব হবে না।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী