ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রাকৃতিক নেয়ামত ফল

মিনহাজুল আরিফীন
প্রাকৃতিক নেয়ামত ফল

আল্লাহতায়ালার বিস্ময়কর এক সৃষ্টি ও নিদর্শনের নাম ফল। এটি আল্লাহতায়ালার এমন এক নেয়ামত, যা সবাই পছন্দ করে। আল্লাহতায়ালা তার পবিত্র গ্রন্থে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের নয়নাভিরাম দৃশ্য, নেয়ামতরাজি ও কুদরতসমূহের বর্ণনা মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন।

অতীত ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিধি-বিধান থেকে শুরু করে সব প্রয়োজনীয় বিধি-বিধানের পাশাপাশি বাদ যায়নি পশুপাখি, ফল-মূল, তরুলতা ও গাছ-গাছালির বিবরণও। কারণ, পবিত্র কোরআনুল কারিম ও হাদিস শরিফের বিশাল ভান্ডার যেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক জীবন্ত বিশ্বকোষ।

যেমন- আল্লাহতায়ালা এক আয়াতে বলেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক। আমিই প্রচুর বারি বর্ষণ করি। পরে আমি ভূমি প্রকৃষ্টরূপে বিদীর্ণ করি এবং আমি তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাক-সবজি, জাইতুন, খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট বাগান, ফল ও গবাদি খাদ্য। এটা তোমাদের ও তোমাদের জীবজন্তুর ভোগের জন্য।’ (সুরা আবাসা : ২৪-৩২)। আল্লাহতায়ালা অন্য আরেক আয়াতে বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল ফলান। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা নাহল : ১১)। এ ছাড়া কোরআনে আল্লাহতায়ালা বিভিন্ন উদ্ভিদের নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করেছেন। কয়েকটি সুরার নামকরণও করা হয়েছে উদ্ভিদের নামে। আবার কোনো কিছুর প্রমাণস্বরূপ কিংবা সাধারণ বর্ণনা হিসেবে এসেছে উদ্ভিদের নাম। যার কিছু তুলে ধরা হলো-

খেজুর গাছ : খেজুর গাছ থেকে যে খেজুর উৎপন্ন হয়, তা অনেক শক্তিশালী খাদ্য, যা মানুষের জন্য অনেক উপকারী। খেজুর বান্দার জন্য মহান আল্লাহর এক মহা নেয়ামত। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘শস্যখেত দুর্বল ও ঘন গোছাবিশিষ্ট খেজুর বাগানে।’ (সুরা শুআরা : ১৪৮)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি খেজুর গাছের কাণ্ড ধরে নাড়া দাও। তোমার ওপর তা ফেলবে পাকা তাজা খেজুর।’ (সুরা মারইয়াম : ২৫)।

জলপাই বা জয়তুন : মহাঔষধি গুণে ভরপুর জলপাই। জলপাই অনেক ধরনের হয়ে থাকে। এ থেকে তৈরি হয় অনেক উন্নতমানের তেল। যার কদর রয়েছে বিশ্বব্যাপী। আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে এ জয়তুন তথা জলপাইয়ের শপথ করে বলেছেন, ‘ডুমুর ও জলপাই (বা তার গাছ)-এর শপথ।’ (সুরা তীন : ১)। আল্লাহতায়ালা অন্য আয়াতে বলেন, ‘যিনি তোমাদের জন্য তা (পানি) দিয়ে শস্য, জাইতুন, খেজুরগাছ, আঙুর ও সব ধরনের ফল ফলান। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা নাহল : ১১)।

আঙুর : লতা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন ফল হলো আঙুর। অনেক সুমিষ্ট ও উপকারী ফল এটি। একই থোকায় ৬ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত উৎপন্ন হয়। কোরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা এ ফলের কথা তুলে ধরেছেন। বিজ্ঞানে প্রমাণিত যে, অনেক জটিল ও কঠিন রোগের প্রতিষেধক রয়েছে লতা জাতীয় উদ্ভিদ থেকে উৎপন্ন ফল আঙুরে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আঙুর ও শাক-সবজি।’ (সুরা আবাসা : ২৮)।

আনার : ডালিম নামে পরিচিত ফলকে কোরআনের ভাষায় বলা হয়েছে ‘রুম্মান’। গুল্ম জাতীয় গাছ থেকে উৎপন্ন হয় এ ফল। এটাকে অনেকে আনার হিসেবেই জানে। এ ফলটির কথাও কোরআনে এসেছে, ‘সেখানে রয়েছে ফলমূল; খেজুর ও আনার।’ (সুরা আর রহমান : ৬৮)।

ডুমুর বা তীন ফল : বিশ্বব্যাপী বহু প্রজাতির ডুমুর রয়েছে। এক ধরনের মিষ্টি জাতীয় পাতলা আবরণযুক্ত নরম ফল ডুমুর। গাছ, লতা, গুল্ম জাতীয় ভিন্ন ভিন্ন গাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের ডুমুর উৎপন্ন হয়। কোরআনুল কারিমে এ নামে একটি সুরাও নাজিল হয়েছে। তা হলো, সুরা তীন। তীন শব্দের অর্থেই হলো ডুমুর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ডুমুর ও জলপাইয়ের (বা তার গাছ) শপথ।’ (সুরা তীন : ১)।

সবজি-শস্য : নানান ধরনের বীজচারা বা শস্যের কথা কোরআনে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন খেজুর গাছ ও বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য।’ (সুরা আনআম : ১৪১)। এ ছাড়া সুরা বাকারায় রয়েছে পেঁয়াজ, কাকড়ি ও ডালের বর্ণনা।

দেশীয় ফল-ফলাদির উপকারিতা : অনেকেরই ধারণা, দামি ও বিদেশি ফলের পুষ্টিগুণই বেশি। তাই রোগ-বালাই হলে আঙুর, আপেল, মাল্টার মতো বিদেশি ফল কেনা হয়। এমন ধারণা অমূলক। বিদেশি ফল-ফলাদির পাশাপাশি কিছু দেশি ফলও রয়েছে, যেগুলোর দামও অনেক কম এবং পুষ্টিগুণও তুলনামূলক বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও দেশি ফলের জুড়ি নেই। বিশেষত শিশুদের দেশি ফল খেতে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন- আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তাল, জামরুল, পেয়ারা, সফেদা, আনারস, তরমুজ, বেল, আতা, নারিকেল, ডেউয়া, কামরাঙা, বাঙ্গি, গাব, বেতফল, শরিফা, খেজুর, করমচা ইত্যাদি। উল্লেখযোগ্য কিছু দেশি ফলের পুষ্টিগুণ হলো-

আম : আমে থাকা ভিটামিন-ই, কপার, ভিটামিন-বি এবং ফলেট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বিশেষভাবে ইনফেকশন জাতীয় সমস্যা দূরে রাখতে সাহায্য করে। আমে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম। এগুলো শরীরের কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ ছাড়া হজমশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বেশ কাজ করে।

আমড়া : আমড়ায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-বি ও সি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ক্যারোটিন, পেকটিন ও ফাইবার রয়েছে। তিনটি আপেলের চেয়ে একটি আমড়ার পুষ্টিগুণ বেশি। আমড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তস্বল্পতা দূর করে, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। আমড়ায় থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বক, চুল ও নখের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।

আমলকি : আমলকিতে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন-সি রয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, মৌসুমি সর্দি-কাশি কমাতে, মুখের রুচি বাড়াতে, ত্বক ও চুল সুন্দর রাখতে, রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক এ ফল।

পেয়ারা : একটি পেয়ারায় চারটি কমলালেবুর চেয়েও বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে। এতে প্রচুর ভিটামিন-এ, বি, সি ও কে এবং ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফাইবার রয়েছে। এতে থাকা ভিটামিন-এ চোখের জন্য ভালো। পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুবই উপকারী।

কলা : মেডিসিননেট রিপোর্ট অনুসারে, কলায় প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে। ফলে কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে এটি একটি দুর্দান্ত ফল। উপরন্তু এটি ভিটামিন-ই-সমৃদ্ধ, যা লিভার এবং কিডনিকে শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করতে সাহায্য করে। ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম অক্সালেট কিডনির পাথরের ক্রিস্টাল বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।

মৌসুমি ফলের উপকারিতা : বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সারাবছর কোনো না কোনো ফলের সমারোহ থাকে। বিশেষ করে, জৈষ্ঠ্য মাস আসে নানা প্রজাতির রসালো ফলের সুবাস নিয়ে। বাজারে ফলের দোকানে, রাস্তার ধারে থরে থরে সাজানো আম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, কালোজাম, বাঙ্গিসহ নানা রকম রসালো ফল। মিষ্টি ফলের লোভনীয় গন্ধ। ফল রসে রসনা তৃপ্তির অপূর্ব আনন্দময় মাস এ জ্যৈষ্ঠ। বাঙালির ঘরে ঘরে পুরো জ্যৈষ্ঠ মাস চলে আনন্দ, চলে আত্মীয়-স্বজনদের আনাগোনা ও ফল-ফলাদি আদান-প্রদান। বিশেষ করে, বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠালের কথা না বললেই নয়। এটি এমন এক ফল, যার আগাগোড়া সবটাই কাজে লাগে। কাঁঠাল কাঁচাবস্থায় সবজিরূপেও মজা করে খায় এ দেশের মানুষ। অন্যদিকে কাঁঠালের বিচি (দানা) বাদামের মতো ভেজে, সিদ্ধ করে সবজিরূপেও খাওয়া হয়। এ সবই লোভনীয় ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। বস্তুত এসব মৌসুমি ফল আল্লাহতায়ালার অপূর্ব নেয়ামত বিশেষ। মানুষ সাধারণত রান্না করে খাবার খায়। কিন্তু ফল এমন একটি নেয়ামত, যা রান্না করতে হয় না। খাওয়ার পর পানি পান করার প্রয়োজন হয় না। কারণ, অধিকাংশ ফলেই পরিমিত পরিমাণ পানি আছে। মৌসুমি এসব ফলের উপকার বলে শেষ করা যাবে না। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, মানুষের শরীরে রোগের প্রতিষেধক হিসেবে মৌসুমি ফল-ফলাদির চেয়ে অধিক কার্যকরী ভিন্ন কোনো ওষুধ নেই।

এসব ফলমূল খেয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর আনুগত্য প্রকাশ করার পাশাপশি নিঃস্ব, অসহায়, দরিদ্রপীড়িত লোকদের (যারা এগুলো কিনে খেতে সক্ষম নয়) দান করাও অনেক বড় সওয়াবের কাজ। সুস্বাস্থ্যকর ফলমূল আমাদের প্রত্যেকের জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি, সুখ আর সীমাহীন তৃপ্তি।

ফল ব্যবসায়ীদের করণীয় : ফলমূলের এ মৌসুমে প্রত্যেকেই ফল খেতে চায়। তবে সাবধান থাকতে হয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী থেকে। কারণ, তারা দ্রুত পাকানো ও চমক বাড়ানোর জন্য আল্লাহর দেয়া এসব নেয়ামতের মধ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য মেশায়। ফলে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যায়। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের থেকে যোজন যোজন দূরে থাকতে হবে। যারা এমন অন্যায় করছে, তাদেরকে সাবধান করতে হবে। সাবধান না হলে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকার-সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সহযোগিতা করা প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলমানরা নিরাপদ থাকে, সে-ই প্রকৃত মুসলমান। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে, সে-ই প্রকৃত মোমিন।’ (তিরমিজি : ২৬২৭)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত