ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মহাবিশ্বের বিস্ময়

মিনহাজুল আরিফীন
মহাবিশ্বের বিস্ময়

আল্লাহতায়ালা মানুষের জাগতিক জীবন সুন্দর, স্বার্থক ও পূর্ণাঙ্গ করতে সৃষ্টি করেছেন এ বিশ্বচরাচরের সবকিছু। মানুষ তাঁর সব নেয়ামত ভোগ করে একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে; পার্থিব নেয়ামতকে কাজে লাগিয়ে পরকালের অনন্ত জীবনের সুখ সন্ধান করবে, এটাই তাঁর লক্ষ্য। আল্লাহতায়ালার অসংখ্য অগণিত সৃষ্টিকুলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সমুদ্র। সমুদ্র আল্লাহর এমন এক বৃহৎ ও বিস্ময়কর সৃষ্টি, যাতে রয়েছে মানুষের জন্য জানা-অজানা নানা অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের নিরন্তর কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে সমুদ্র। চলছে সমুদ্র নিয়ে মানুষের বিরামহীন গবেষণা ও অনুসন্ধান। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছে সমুদ্রগর্ভের নানা রহস্যজাল। সমুদ্র নিয়ে মানুষ যত জানছে, যত গবেষণা করছে, নিত্য-নতুন চমকপ্রদ সব তথ্য আবিষ্কৃত হচ্ছে। আল্লাহতায়ালা সমুদ্রে মানুষের জন্য পানি, লবণ, মাছ, গ্যাসসহ যে বহুবিধ খনিজ সম্পদের অফুরান কল্যাণের ভাণ্ডার সুপ্ত রেখেছেন, তা গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ দিন দিন উপকৃত হচ্ছে। এ জন্যই সমুদ্রকে বলা হয়, মহান স্রষ্টার সৃষ্টির অন্যতম এক মহাবিস্ময়। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামে সমুদ্র নিয়েও চিন্তা-গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের বহু স্থানেও আলোচনা এসেছে সমুদ্রে নিহিত নেয়ামতরাজির বিভিন্ন দিক নিয়ে। যেমন- আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি দেখ না যে, ভূপৃষ্ঠে যা আছে এবং সমুদ্রে চলমান নৌকা তৎসমুদয়কে আল্লাহ নিজ আদেশে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি আকাশ স্থির রাখেন, যাতে তাঁর আদেশ ছাড়া ভূপৃষ্ঠে পতিত না হয়। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি করুণাশীল, দয়াবান।’ (সুরা হজ : ৬৫)।

আল কোরআনে সামুদ্রিক মাছ : আল্লাহর সৃষ্টির অপার রহস্যের আধার এ সমুদ্র। সমুদ্রের অন্যতম নেয়ামত হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। পবিত্র কোরআনেও সামুদ্রিক মাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক প্রসঙ্গে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সে সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার অলংকারাদি, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে নৌযান দেখবে, তা পানি চিরে চলছে এবং যাতে তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অন্বেষণ করতে পার এবং যাতে তোমরা শোকরিয়া আদায় কর।’ (সুরা নাহল : ১৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘দুটি সমুদ্র সমান নয়; একটি খুবই সুমিষ্ট ও সুপেয়, আরেকটি অত্যন্ত লবণাক্ত। আর প্রত্যেকটি থেকে তোমরা তাজা গোশত খাও এবং আহরণ কর অলঙ্কার, যা তোমরা পরিধান কর। আর তুমি তাতে দেখ নৌযান, যা পানি চিরে চলাচল করে। যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’ (সুরা ফাতির : ১২)। আয়াতদ্বয়ে সাগরের মাছকে আল্লাহতায়ালা তাজা গোশত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাজা গোশতের উপকারিতার শেষ নেই। তাজা গোশত মূলত পূর্বোক্ত সামুদ্রিক মাছের বহুবিধ উপকারিতারই ইঙ্গিত করছে। সামুদ্রিক বড় বড় মাছের হাড় দিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও আসবাব বানানো হয়। আল্লাহতায়ালা সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন আয়াতদ্বয়ে। আর সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল ও শামুকে মুক্তো পাওয়া যায়, যা মূল্যবান অলংকারাদিতে শোভা বৃদ্ধি করে। তা ছাড়া মানুষের উপকারার্থেই আল্লাহতায়ালা সাগর ও এর উদরস্থ যাবতীয় সামগ্রী প্রস্তুত করেছেন। তাই তিনি এর শিকার ও তার গোশত ভক্ষণ বৈধ আখ্যা দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে সমুদ্রের শিকার ও তার খাদ্য; তোমাদের ও মুসাফিরদের ভোগের জন্য।’ (সুরা মায়িদা : ৯৬)।

মানবেতিহাসের সূচনা থেকেই সমুদ্রতীরের মানুষ তার জীবিকার সন্ধানে সাগর ভ্রমণ করেছে। সাগরের পানির পবিত্রতা, এর প্রাণী শিকার ও মাছের গোশত আহারের বৈধতা ঘোষিত হয়েছে তাই মহাজ্ঞানী রাসুল (সা.)-এর পবিত্র জবানেও। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা সমুদ্রপথে আসা-যাওয়া করি এবং সঙ্গে সামান্য মিঠা পানি নিই। যদি আমরা তা দিয়ে অজু করি, তাহলে পিপাসার্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ক্ষেত্রে আমরা কি সমুদ্রের পানি দিয়ে অজু করতে পারি?’ রাসুল (সা.) বলেন, ‘সমুদ্রের পানি পবিত্র ও তার মৃত জীব হালাল।’ (তিরমিজি : ৬৯)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি সমুদ্রকে নিয়োজিত করেছেন, যাতে তোমরা তা থেকে তাজা (মাছের) গোশত খেতে পার।’ (সুরা নাহল : ১৪)। এ আয়াতে ‘তাজা গোশত’ শব্দের ব্যাখ্যায় তাফসিরবিদ ইবনে জারির তাবারি (রহ.) লিখেছেন, ‘তাজা গোশত হলো, সমুদ্র থেকে শিকারকৃত মাছ।’ (তাফসিরে তাবারি : ১৭/১৮০)।

সমুদ্রে কোরআনের বিস্ময় : আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন, দুই সমুদ্রের পানি পরস্পর সম্মিলিত হয় না। যেমন- রোম সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের পানি একটি অপরটির সঙ্গে একীভূত হতে পারে না। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী সমুদ্র বঙ্গোপসাগরেও রয়েছে এমন দর্শন, যা নিজ চোখে দেখা হয়েছে। সেখানে রয়েছে বিস্ময়কর এক অদৃশ্য অন্তরায়। অথচ যে যুগে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর কোনো যন্ত্রসামগ্রী ছিল না, তখনো কোরআন বলে দিয়েছে, ‘তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করে না। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? উভয় সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় মণিমুক্তা ও প্রবাল। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে? আর সমুদ্রে চলমান পাহাড়সম জাহাজসমূহ তাঁরই। সুতরাং তোমাদের রবের কোন নেয়ামতকে তোমরা উভয়ে অস্বীকার করবে?’ (সুরা আর রহমান : ১৯-২৫)। দুই সমুদ্র বলতে মিঠা ও লোনা সমুদ্র বোঝানো হয়েছে।

আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে উভয় প্রকার দরিয়া সৃষ্টি করেছেন। কোনো কোনো স্থানে উভয় দরিয়া একত্রে মিলিত হয়ে যায়, যার নজির পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু যে স্থানে মিঠা ও লোনা উভয় প্রকার দরিয়া পাশাপাশি প্রবাহিত হয়, সেখানে বেশ দূর পর্যন্ত উভয়ের পানি আলাদা ও স্বতন্ত্র থাকে। একদিকে থাকে মিঠা পানি, অপরদিকে লোনা পানি। কোথাও কোথাও এ মিঠা ও লোনা পানি ওপরে-নিচেও প্রবাহিত হয়। পানি তরল ও সূক্ষ্ম পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরে মিশ্রিত হয় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বল তো- কে পৃথিবীকে বাসপোযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন; আর তাকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন? অতএব, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।’ (সুর নামল : ৬১)। অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, ‘তিনি সমান্তরাল দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন- একটি মিষ্টি, তৃষ্ণা নিবারক ও একটি লোনা, বিস্বাদ। আর উভয়ের মাঝে রেখে দেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।’ (সুরা ফোরকান : ৫৩)।

সামুদ্রিক বিস্ময়তায় আল্লাহর নিদর্শন : সুবিশাল গভীর সমুদ্রে কত জাতের, কত বর্ণের, কত আকারের কত রকম প্রাণী যে বিদ্যমান, তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তবে বিশ্বাসী চিন্তানায়ক ও ধর্মতাত্ত্বিকরা সব সময়ই আল্লাহর পরিচয় জানতে সাগর ভ্রমণে অশেষ উপকারিতার কথা বলেন। সমুদ্রের বুকে গিয়ে মানুষ মহান স্রষ্টা আল্লাহর অতুলনীয় সৃষ্টিকুশলতা উপলব্ধি করতে পারে। আমরা তো দয়ালু ও দাতা আল্লাহকে চেনার মতো চিনতে কসুর করি, আল্লাহর অসীমতা উপলব্ধি করে তাঁর নির্দেশানুযায়ী জীবন পরিচালনায় ত্রুটি করি। এ ক্ষেত্রে সুবিস্তৃত আকাশ, সুউচ্চ পর্বত ও সুবিশাল সাগর প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানই পারে মানুষকে মহান আল্লাহর কুদরতের বাস্তব উপলব্ধি এনে দিতে। সাগরের বুকে ঘুরতে গিয়ে দিগন্তহীন অথৈ জলরাশির বিশাল তরঙ্গমালায় কেউ যখন মৃত্যুর খুব কাছে নিজেকে আবিষ্কার করে, তখনই সত্যিকার উপলব্ধি করে আল্লাহর অসীমতার অর্থ কী! আর সৃষ্টির ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা কী! এ জন্যই আল্লাহর নির্দেশ, ‘বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর এবং দেখ, কীভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন! অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।’ (সুরা আনকাবুত : ২০)।

আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘নিশ্চয় আসমান ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাতদিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাগুলোর চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি অবতীর্ণ করেছেন, তা দ্বারা মৃত জমিনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেন সব রকম জীবজন্তু। আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালা (যা তাঁরই হুকুমে) আসমান ও জমিনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয় বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য সেসব বিষয়ে নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা বাকারা : ১৬৪)।

আমাদের করণীয় : সমুদ্রের এমন সব অফুরন্ত নেয়ামতের দাবি হলো, নেয়ামতদাতাকে নিয়ে চিন্তা করা। তিনি কীভাবে এত সাগর-মহাসাগর মানুষের পদানত করেছেন, তাতে এত নেয়ামতসম্ভার সন্নিবেশিত করেছেন, তা নিয়ে ভাবনা-গবেষণা করা।

বহুবিধ ঝুঁকি ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাগরতলের নেয়ামতরাজি মানবকল্যাণে আবিষ্কার করা। মানুষের আরো কর্তব্য হলো, একমাত্র আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করা এবং তাঁরই ইবাদত করা। পাশাপাশি প্রাণহীন মূর্তি ও প্রতিমাসহ আল্লাহ ছাড়া সবকিছুর প্রভুত্ব অস্বীকার করা। আল্লাহতায়ালা এ কথাই বলেছেন কোরআনের এক আয়াতে, ‘বল তো! কে পৃথিবীকে বাসপোযোগী করেছেন, তার মাঝে মাঝে নদ-নদী প্রবাহিত করেছেন, তাকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন? অতএব, আল্লাহর সঙ্গে অন্য কোনো উপাস্য আছে কি?

বরং তাদের অধিকাংশই তা জানে না।’ (সুরা নামল : ৬১)। অতএব, মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, আল্লাহতায়ালার সমগ্র নেয়ামত নিয়ে চিন্তা-ফিকির করা এবং শোকরিয়া আদায় করা। কারণ, আল্লাহতায়ালা কোরআনে ঘোষণা দেন, ‘যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, যদি তোমরা শোকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেব; আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, (তাহলে মনে রেখ, ) নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। কোরআনের ভাষ্যমতে, আল্লাহতায়ালার কৃতজ্ঞতা আদায় করতে হবে প্রশান্ত হৃদয়ে, বিনয় ও নম্রতার সঙ্গে এবং অনুসরণ করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থার। যারা এভাবে জীবন অতিবাহিত করতে পারে, তারাই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারবে। তাদের জীবন হবে সুখময়। এজন্য অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৪)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত