প্রকৃতি-পরিবেশ অনন্য নেয়ামত

মিনহাজুল আরিফীন

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের জীবন ধারণের এক অপরিহার্য উপাদান প্রকৃতি ও পরিবেশ। পৃথিবীর সবকিছুই সংঘটিত হচ্ছে আল্লাহতায়ালার নির্দেশে। তাঁর নির্দেশেই সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিরূপ আচরণ তাঁর ইশারাতেই ঘটে। মহান রাব্বুল আলামিন পৃথিবীকে মানব বসবাসের উপযোগী করে তোলার জন্য যা যা প্রয়োজন, তার সবই তৈরি করে রেখেছেন মানুষের জন্য। মানব জাতির সব চাহিদা পূরণের যাবতীয় আয়োজন বিদ্যমান রয়েছে পৃথিবীর সর্বত্র। প্রকৃতি ও পরিবেশ বলতে আমরা বুঝি আমাদের চারপাশের অবস্থা। এ বিশ্ব পরিমণ্ডলের পাহাড়-সাগর, ঝরনা-নহর, নদী-নালা, বাড়ি-ঘর, ফুল-ফলের বৃক্ষবহর আর হরেক রকমের জীবজন্তু ও পশুপাখিসহ নেয়ামতরাজির নানা আয়োজন। এগুলো সবই আল্লাহর দেয়া নৈসর্গিক বা প্রাকৃতিক পরিবেশের অংশ।

এ পরিবেশ ও প্রকৃতির মৌলিক উপাদান হচ্ছে পানি ও মাটি। মূলত মাটি থেকেই গাছপালা, তরুলতা ইত্যাদি উৎপন্ন হয় এবং উৎপাদিত শস্য পানি থেকে প্রাণ সঞ্চার করে। এ প্রসঙ্গে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য। তারা তা ভক্ষণ করে। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝরনাধারা; যাতে তারা ফল খায়।’ (সুরা ইয়াসিন : ৩৩)। এছাড়া মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে আল্লাহর দেয়া প্রকৃতির মধ্যে যে ইতিবাচক কল্যাণকর পরিবর্তন সৃষ্টি করে, তা হলো সামাজিক পরিবেশ। যেমন- রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, কলকারখানা ইত্যাদি। মনে রাখতে হবে, সামাজিক পরিবেশ বিনির্মাণে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাবে না, যা প্রকৃতিতে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে।

প্রকৃতি-পরিবেশ আল্লাহর দান : পৃথিবীর যত পশুপাখি, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত, বন-বনানী সবই প্রকৃতির বিশেষ দান বা আশীর্বাদ। যে দানে প্রকৃতির স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা নেই। পৃথিবীর সমগ্র প্রাণীর জন্যই প্রকৃতি এ বিশেষ দান সমবণ্টন করে রেখেছে। এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি প্রাণীই প্রকৃতিকে নানাভাবে ভোগ করে আসছে লক্ষ-কোটি বছর ধরে। হতে পারে সেটি জলবায়ু গ্রহণের মাধ্যমে, হতে পারে খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে কিংবা হতে পারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকনের মাধ্যমে। অর্থাৎ প্রাণীজগৎকে টিকে থাকতে হলে প্রকৃতির স্বাদ আস্বাদনের বিকল্প নেই। আমাদের চারপাশে যা কিছু রয়েছে এবং যা প্রাকৃতিক পরিবেশ হিসেবে খ্যাত, এগুলো মহান স্রষ্টার অপার নেয়ামত। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘আমি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছি ও এতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি। আমি পৃথিবীতে প্রতিটি বস্তু সুপরিমিতভাবে উৎপন্ন করেছি। আমি তোমাদের জন্য তাতে জীবিকার ব্যবস্থা করেছি। তোমরা যাদের রিজিকদাতা নও, তাদের জন্যও। প্রতিটি বস্তুর ভাণ্ডার আমার কাছে আছে এবং আমি তা প্রয়োজনীয় পরিমাণেই সরবরাহ করে থাকি। আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি। অতঃপর আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি। আর তা তোমাদের পান করতে দিই। বস্তুত এর ভাণ্ডার তোমাদের কাছে নেই।’ (সুরা হিজর : ১৯-২২)।

গাছপালা পরিবেশের অমূল্য নেয়ামত : বৃক্ষ বা গাছ মহান আল্লাহর অনিন্দ্য সৃষ্টি। গাছপালা না থাকলে এ পৃথিবীতে বসবাস করা অসম্ভব ছিল। পরিবেশ তথা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা এবং মানবোন্নয়নে গাছের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই গাছ মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের ও আমাদের পরিবেশের জন্য অমূল্য নেয়ামত। এ ছাড়া বৃক্ষে আছে অফুরন্ত রিজিক। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘পৃথিবীকে আমি উৎপন্ন করেছি সব ধরনের নয়নাভিরাম উদ্ভিদ প্রত্যেক বিনীত ব্যক্তির জন্য, যা চাক্ষুষ জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ। আর আমি আকাশ থেকে বরকতময় বৃষ্টি বর্ষণ করি। অতঃপর তার মাধ্যমে বাগান ও শস্য বীজ উদ্গত করি। আর দীর্ঘ খেজুরগাছ; যাতে থাকে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুরের মোচা, বান্দাদের জীবিকা হিসেবে। আমি এর দ্বারা জীবিত করি মৃত জনপদকে। আসলে এভাবেই হবে পুনরুত্থান।’ (সুরা কফ : ৭-১১)।

ফসল ও ফলমূল আল্লাহর অপার দান। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যে শস্য বীজ বপন কর, সে বিষয়ে ভেবে দেখেছ কি? তোমরা কি ওটা উৎপন্ন কর নাকি আমি উৎপন্ন করি? আমি চাইলে অবশ্যই তা খড়কুটায় পরিণত করতে পারি। তখন তোমরা হতবুদ্ধি হয়ে পড়বে। (বলবে), আমরা তো নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে গেলাম; বরং আমরা তো বঞ্চিত হয়ে গেলাম।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৬৩-৬৭)।

গাছ থেকে উৎপাদিত ফল-ফসল খেয়ে প্রাণীকুল জীবন ধারণ করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করি পরিমাণমতো। অতঃপর তা জমিনে সংরক্ষণ করি। আর আমি ওটাকে সরিয়ে নিতেও সক্ষম। অতঃপর আমি তা দিয়ে তোমাদের খেজুর ও আঙুরের বাগান সৃষ্টি করি। তোমাদের জন্য সেখানে থাকে প্রচুর ফল-ফলাদি এবং তোমরা তা থেকে ভক্ষণ করে থাক। আর আমি সৃষ্টি করেছি (জয়তুন) বৃক্ষ; যা সিনাই পর্বতে জন্মায়। যা থেকে উৎপন্ন হয় তেল এবং ভক্ষণকারীদের জন্য রুচিসম্মত খাদ্য।’ (সুরা মোমিনুন : ১৮-২০)।

গবাদিপশুর জীবিকাও বৃক্ষ, লতাপাতা থেকে উৎপন্ন হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি দেখে না যে আমি ঊষর ভূমিতে (বৃষ্টির) পানি প্রবাহিত করি। অতঃপর তার মাধ্যমে শস্য উৎপাদন করি। যা থেকে ভক্ষণ করে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা। এরপরও কি তারা উপলব্ধি করবে না?’ (সুরা সাজদা : ২৭)।

পাহাড়-পর্বত প্রকৃতির রক্ষাকবচ : পাহাড়-পর্বত আল্লাহতায়ালার নেয়ামতরাজির মধ্যে এক অপার রহস্যময় নেয়ামত। লোকচক্ষুর আড়ালে নানা অজানা উপকার লুকিয়ে রয়েছে এ পাহাড়-পর্বতে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই (আল্লাহ) জমিনকে বিস্তৃত করেছেন এবং এর মধ্যে পর্বত ও নদী সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি প্রত্যেক ফল সৃষ্টি করেছেন দু-ধরনের। তিনি দিবসকে রাত দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। এতে অবশ্যই চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন আছে।’ (সুরা রাদ : ৩)। আলোচ্য আয়াতে পৃথিবীর বিস্তৃতি, নদ-নদী, ফল-ফসল ও দিনরাতের সৃষ্টি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। আয়াতের প্রথম কথা হলো, আল্লাহতায়ালা জমিনকে বিস্তৃত করেছেন। এরপর বিস্তৃত জমিনে ভারসাম্য রাখার জন্য তিনি পাহাড় ও নদী সৃষ্টি করেছেন। এ পাহাড় আল্লাহতায়ালা অহেতুক সৃষ্টি করেননি। পাহাড়ের সৌন্দর্য মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে পাহাড়ের ওজন স্থাপন করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। পাহাড় সৃষ্টি করা হয়েছে, যাতে পৃথিবী নড়াচড়া করতে না পারে। পৃথিবী নড়াচড়া করলে পৃথিবীর বুকে বসবাসকারীদের পৃথিবীতে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে যেত। এ বিষয়ে কোরআনে এসেছে, ‘আমি জমিনের ওপর সৃষ্টি করেছি সুদৃঢ় পর্বতমালা, যাতে তাদের নিয়ে পৃথিবী ঝুঁকে না পড়ে।’ (সুরা আম্বিয়া : ৩১)।

আধুনিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে ডা. ফ্রাংক প্রেস সর্বপ্রথম বলেছিলেন, পর্বতের অত্যন্ত গভীর শিকড় আছে পৃথিবীর অভ্যন্তরে। সত্যিকারার্থে পর্বত হচ্ছে একটি ভাসমান বরফ বা খুঁটির মতো, যার ৯০ শতাংশ থাকে পানির নিচে আর ১০ শতাংশ থাকে ওপরে।

পর্বতগুলো ভূমির ওপরে ও নিম্নদেশে বিস্তৃত হয়ে পেরেকের মতো ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন প্লেটকে দৃঢ়ভাবে আটকে ধরে রাখে। ভূপৃষ্ঠের ওপরের অংশ বা ক্রাস্ট অবিরাম গতিশীল প্লেট নিয়ে গঠিত। পর্বতগুলো দৃঢ়ভাবে ধরে রাখার বৈশিষ্ট্যই ভূপৃষ্ঠের ওপরের স্তরকে ধরে রাখে। এর মাধ্যমে ভূকম্পন প্রতিরোধ করে অনেকাংশে। এ জন্যই তো পাহাড় বা পর্বতশ্রেণিকে বলা হয় প্রকৃতির পেরেক। ভূমিকম্প প্রতিরোধক বললেও ভুল হবে না। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, আধুনিক বিজ্ঞান এ বিষয়ে মতামত দিয়েছে এইতো ক’দিন। কিন্তু এর হাজারো বছর আগে কোরআন এ বিষয়ে খবর দিয়েছে। কোরআনের একটি আয়াতে পাহাড়কে সরাসরি পেরেকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি কি জমিনকে করিনি বিছানাসদৃশ এবং পাহাড়গুলোকে পেরেকস্বরূপ?’ (সুরা নাবা : ৬-৭)।

ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ প্রদান : আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের সুস্থ, সুন্দর ও স্বাভাবিক বাসোপযোগী করে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। তাই তো আমরা দেখি প্রচণ্ড শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যেখানে বছরের প্রায় পুরোটাজুড়ে মাঠ-ঘাট, নদী-নালা সর্বত্রই বরফে ঢাকা থাকে, সেখানেও প্রাকৃতিক উদ্ভিদকুল সবুজের ডানা মেলে এবং বরফ আচ্ছাদিত মৎস্যকুল স্বাভাবিক জীবন পরিচালনের মাধ্যমে স্রষ্টার অপার মহিমার জানান দেয়। প্রতিটি প্রাণীরই ভারসাম্যপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ দরকার। পৃথিবীতে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা জীবজগতের অস্তিত্ব রক্ষায় আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন বৃক্ষরাজি ও পাহাড়-সাগর। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ভূমিকে করেছি সুবিস্তৃত ও তাতে স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং উৎপন্ন করেছি নয়নাভিরাম উদ্ভিদরাজি। এটি আল্লাহর অনুরাগী বান্দাদের জন্য জ্ঞান ও উপদেশস্বরূপ।’ (সুরা কফ : ৭-৮)।

পরিবেশের আরেকটি আবশ্যিক উপাদান হচ্ছে আলো। আল্লাহতায়ালা চন্দ্র-সূর্য ও দিনরাতকে এমন কুদরতিভাবে পরিমিত উষ্ণতা ও শীতলতার মিশেলে পরিচালনা করছেন যে, এটাই মানবসমাজ, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য শান্তিদায়ক ও ভারসাম্যপূর্ণ। এরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি অনুধাবন করে না, আমি রাত সৃষ্টি করেছি তাদের বিশ্রামের জন্য এবং দিনকে করেছি আলোকিত। এতে মোমিন সম্প্রদায়ের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা নামল : ৮৬)।