পানি ব্যবহারে মিতব্যয়িতা
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পানি আল্লাহর অপার নেয়ামত। পানি থেকেই আল্লাহতায়ালা সমগ্র প্রাণবান বস্তু সৃষ্টি করেছেন। এরশাদ হচ্ছে- ‘আমি পানি থেকেই প্রাণিকুল সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ৩০)। মানুষের জীবন ধারণের মূল উপাদান পানি। শুধু মানুষের নয়, উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্যও পানির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এরশাদ হচ্ছে- ‘আমি তো আকাশ থেকে বারিধারা বর্ষণ করি। তা থেকেই উদ্ভিদসমূহের জন্ম হয়। যেগুলোতে তোমরা পশু চারণ করে থাকো।’ (সুরা নাহল : ১০)। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) প্রিয়তম রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন- ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! এমন কোনো বস্তু রয়েছে, যা থেকে মানুষকে বারণ করা যায় না?’ রাসুল (সা.) বললেন- ‘পানি।’ (সহিহ বোখারি : ৩৪৭৭)। আরেকটি হাদিসে বর্ণিত আছে; একদা রাসুল (সা.) এরশাদ করলেন- ‘তিনটি নেয়ামত এমন রয়েছে, যা সর্বসাধারণের জন্য ব্যাপক করে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে- পানি, ঘাস, বাতাস।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৭৭)। পানির মাধ্যমে আল্লাহতায়ালা প্রাণবান সবকিছুকে জীবিত ও সজীব রেখেছেন, আবার পানি দিয়ে অবাধ্য জাতিকে ধ্বংস করার শিক্ষণীয় ঘটনাও রয়েছে সুরা হুদের ৩৯ থেকে ৪৪ নম্বর আয়াতসমূহে। জীবন-মরণ এ পানি। এক ফোঁটা পানির অভাবে হারিয়ে যেতে পারে মহামূল্যবান প্রাণ। গ্রীষ্মের খাঁ খাঁ রোদ্দুরে যখন নদী-নালা, খাল-বিল ও মাঠ-ঘাট শুকিয়ে যায়, তখন সর্বত্রই পানির জন্য হাহাকার পড়ে যায়। তীব্র খরতাপে পানি সংকট দেখা দেয় নগরজীবনে। অথচ এই পানি ব্যবহারে আজ আমরা কতোটা উদাসীন!
আল্লাহতায়ালা যে ইবাদতের জন্য আমাদের সৃষ্টি করেছেন, পানি তার অন্যতম অনুষঙ্গ। রোজ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ অন্যান্য ইবাদতের জন্য পানির ব্যবহার সুবিদিত। একটা সময় এমন ছিলো, মানুষ লোটা বা বদনায় পানি নিয়ে অজু করতো। ফলে পানির অপচয় তেমন হতো না। কিন্তু এখন শহর-বন্দরের প্রায় মসজিদে অজুর জন্য ট্যাপের ব্যবস্থা রয়েছে। তাই একজন মুসল্লি অজু করতে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পানি অপচয় করছেন। অথচ জীবনের সবক্ষেত্রে অপচয়রোধ ও মিতব্যয়ী হওয়ার তাগিদ রয়েছে কোরআনে কারিমে। এরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা খাও, পান করো; কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)। রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যয় কোরো না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৭৮)। প্রিয়তম রাসুল (সা.) এক ‘মুদ্দ’ (প্রায় ১ লিটার বা ৭৯৬ মিলি সমপরিমাণ) পানি দিয়ে অজু সারতেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়। যুক্তির নিরীখে কারোর ধারণা হতে পারে, মরু অঞ্চলে পানির সংকট ছিলো বলে প্রিয়তম রাসুল (সা.) অল্প পানি দিয়ে অজু সারতেন। কিন্তু প্রবহমান নদীর পাশে বসে অজু করলেও মাত্রাতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতে বারণ করেছেন তিনি।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-সূত্রে বর্ণিত আছে; একবার রাসুল (সা.) হজরত সাদ (রা.)-এর পাশ কেটে যাচ্ছিলেন। এ সময় হজরত সাদ (রা.) অজু করছিলেন। তার অজুতে পানি বেশি ব্যয় হচ্ছিলো। প্রিয়তম রাসুল (সা.) তা দেখে বললেন- ‘কেনো এই অপচয়?’ হজরত সাদ (রা.) আরজ করলেন- ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! অজুতেও কি অপচয় হয়?’ রাসুল (সা.) বললেন- ‘হ্যাঁ, এমনকি বহমান নদীতে অজু করলেও।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪২৫)।
প্রিয়তম রাসুল (সা.) বিভিন্ন হাদিসে পানি পান করার আদব শিখিয়েছেন। এগুলো শুধু সুন্নত নয়, বরং এর প্রতিটিতে রয়েছে আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধান। পানি সুরক্ষার জন্য তিনি পানির পাত্র ঢেকে রাখতে এবং বাসনগুলো উল্টে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আরেক হাদিসে তিনি পানির বড় পাত্র থেকে সরাসরি মুখ লাগিয়ে গড় গড় করে পান করতে বারণ করেছেন। বরং ছোট গ্লাস বা পেয়ালায় ঢেলে তারপর দেখে পান করতে শিখিয়েছেন। সুনানে নাসাঈ এবং ইবনে মাজাহসহ বিভিন্ন হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) খাওয়া ও পান করা এবং কাপড় পরাসহ দান-সদকায় অপচয় করতে বারণ করেছেন। এরশাদ হচ্ছে- ‘তোমরা স্থির পানিতে পেশাব কোরো না, নাপাকি ফেলো না। কেননা তা তোমরা ব্যবহার করবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৪৭৮)।
আল্লাহতায়ালা পানি সংরক্ষণ এবং তাকে দূষণের কবল থেকে রক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেসব বস্তু পানির স্বাদ, গন্ধ ও প্রকৃতি পরিবর্তন করে দেয়, সেগুলোর দ্বারা পানির দূষণ ঘটানো যাবে না।
পানি যাতে আকাশের মেঘ থেকে নেমে আসা জলের মতো স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন থাকে, তার জন্য সবাইকে সচেতন হতে হবে। কোরআনে কারিমের বহুসংখ্যক আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আকাশ থেকে বর্ষিত পানির একটি নির্দিষ্ট প্রকৃতি রয়েছে; তা নির্মল, বিশুদ্ধ ও সুপেয়। এরশাদ হচ্ছে- ‘আমি তোমাদের পান করাই সুপেয় পানি।’ (সুরা মুরসালাত : ২৭)। পানি মানুষের জীবনকে চলমান রাখে। পানি ছাড়া মানুষ এক মুহূর্তও টিকতে পারে না। আবার পানির মধ্যে বহু ধরনের রোগ-ব্যাধি ছড়ায়। যা অনেক সময় মানবজীবনকে সংকটাপন্ন করে তোলে। যেসব নেয়ামত ছাড়া এ ভূমণ্ডল অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে, সেগুলোর অন্যতম পানি।
এ মহান নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে রাব্বে কারিম কোরআনে কারিমে সর্বমোট ৪৬ বার পানির কথা উল্লেখ করেছেন। আমাদের দেশ এবং বর্তমান পৃথিবীর গবেষকরা সুপেয় পানির ক্রমবর্ধমান অভাব এবং দূষিত পানির পরিমাণ বৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কিত। অথচ এসবের মূলে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে পানি ব্যবহারে আমাদেরই অপচয় এবং উদাসীনতা। বর্তমান আধুনিক পৃথিবীতে পানির জন্য এ হাহাকার তো আমাদেরই কর্মফল। কেয়ামতের মাঠে যেদিন সব নেয়ামত সম্পর্কে একে একে হিসেব চাওয়া হবে, সেদিন বাদ যাবে না পানির কথাও। সামান্য কয়েক ফোঁটা পানির অপচয় আমাদের কাছে আজ খুব বড় গোনাহ মনে না হলেও মহান শক্তিমানের নিয়োজিত ফেরেশতারা সব লিখে রাখছেন। তাই মুসলমান হিসেবে পানি ব্যবহারে ইসলামের সঠিক নির্দেশনা পালন করা অতীব জরুরি।