শরতের কাশবন
হুমাইদুল্লাহ তাকরিম
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎকাল। শরৎকে ইংরেজিতে ‘অটাম’ বলা হয়। পৃথিবীর চারটি প্রধান ঋতুর একটি হচ্ছে শরৎকাল। পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সেপ্টেম্বর মাসে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে মার্চ মাসে শরৎকালের আগমন ঘটে। এ সময় রাত তাড়াতাড়ি হয়। আবহাওয়া ঠান্ডা হতে থাকে। শরতে হিমঝুরি, গগনশিরীষ, ছাতিম, পাখিফুল, পান্থপাদপ, বকফুল, মিনজিরি, শেফালি, শিউলি, কাশফুলসহ ইত্যাদি ফুল ফুটতে দেখা যায়। কদম ফুলের বর্ষা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় কাশফুলের মেলা। বর্ষার পরেই আসে শরতের কাশবনের সৌন্দর্য। বর্ষার পরপরই যেন লুকিয়ে আসে শরৎ। মানুষ কতই না মুগ্ধ হয় নীলাকাশের মাঝে কখনো কালো মেঘে, কখনো সাদা মেঘের আবরণে লুকিয়ে হাসা সোনালি সূর্য আর তার সঙ্গে বাতাসে শুভ্র সাদা কাশফুলের দোলানো দেখে। বাতাস এলে ফুলগুলো একসঙ্গে দোল খায়। সে দৃশ্য কতই না মনোরম!
শরৎকাল মানে কাশফুলের দিন : খাল-বিল কিংবা নদীর পাড়, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে। এ মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। তাই নদীর তীরেই কাশফুল বেশি দেখা যায়। কোথাও কোথাও কাশফুল ফুটে বাগান সৃষ্টি করে।
কাশফুলের নামটি যেমন দারুণ, তেমনি লিকলিকে শরীরের গাছটি দেখতেও সুন্দর। মানুষ মনে করে, শরৎকাল মানেই কাশফুলের দিন। কাশফুল শরৎকালের অন্যতম রূপ-সৌন্দর্য বর্ধনকারী একটি ফুল। কাশফুলের ঘ্রাণ নেই বটে, কিন্তু আছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। শরতের আকাশ থাকে সাদা মেঘে ভরা; আর নদীর দু’ধার কাশফুলে ভরা। কাশফুল ছিঁড়ে বাতাসে ছেড়ে দিলে পেঁজা তুলোগুলো উড়ে উড়ে যেন মেঘের তুলোর সঙ্গে মিশে যাবে। কাশফুল নিয়ে কতই না লেখালেখি হয়েছে। শরতের দিনে লেখকদের লেখার মূল বিষয় যেন হয়ে ওঠে কাশফুল। শরতের সৌন্দর্য দেখে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার কবিতায় লিখেছেন, ‘কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, স্রষ্টার কী অপার সৃষ্টি!’ জীবনানন্দ দাশ শরৎ বন্দনায় লিখেছেন, ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ এমন শত শত উক্তি রয়েছে কাশফুল নিয়ে।
রৌদ্রছায়ার খেলায় মোহিত হৃদয় : শরৎকালে প্রকৃতিপ্রেমীরা ছুটে বেড়ায় কাশবাগানে। কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করার মাঝে তোলে অজস্র ছবি। শুধু প্রকৃতিপ্রেমী নয়, এ সময়ে সবাই কমবেশি কাশবনে ঘোরাঘুরি করে। কাশবাগান তখন লোকে লোকারণ্য থাকে। অনেকেই কাশবনে আসে পায়ে হেঁটে, কেউ বা সাইকেল বা মোটরসাইকেলে; আরও আসে প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাসে করে। কেউ বা সপরিবারে ঘুরতে আসেন, আবার কেউ প্রিয়জনের সঙ্গে আসেন সোনালি শরতের মিষ্টি গন্ধের স্বাদ নিতে। ছোট ছেলেমেয়েরা কাশফুল নিয়ে খেলা করে। কাশফুল মানেই শরতের দিন আর শরতের দিন মানেই কাশফুল। বর্ষার শেষে বৃষ্টির সমাপ্তি ঘটলে বাংলার নিসর্গ নতুনভাবে সজ্জিত হয়। নীলাকাশে উড়ে বেড়ায় শুভ্র মেঘ। মেঘ-রোদের লুকোচুরি খেলায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে ঝলমলে। বাতাস হয় অমলিন। আকাশ এ সময়ে গাঢ় নীল রঙের হয়ে থাকে। আকাশের ওই ঝলমলে নীল রঙের আভার কিনারা ছুঁয়ে ফুলের মালার মতো দলবেঁধে উড়ে যায় নানা জাতের পাখি। নিসর্গের বুকে শরৎ নিয়ে আসে অন্যরকম এক শোভা। এ সময় বিভাবসুর কিরণে হরিৎ বর্ণের ধানখেত হয়ে ওঠে চির সুখময় স্থান। মৃত্তিকা ও সবুজ ধানগাছের ডগায় রৌদ্রছায়ার খেলা আমাদের মনকে মোহিত করে।
অনন্যতায় ঘেরা শরতের কাশফুল : আশ্বিন এলেই সাদা সাদা তুলোর মতো ফুলে ছেয়ে যায় চারপাশ। ঘ্রাণহীন এ ফুলের আছে ভিন্ন এক রূপ। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে তাই শরৎ মানেই কাশফুল আর কাশফুল দিয়েই শরতের আগমনের বরণ। চোখ জুড়ানো আর মন ভোলানো এ গাছ সচরাচর ফুল গাছের মতো হয় না। লম্বাটে সবুজ গড়নের সাদা পেঁজা তুলোর মতো ডালপালায় ভর্তি কাশফুল। হালকা বাতাসের ছোঁয়াই যেখানে যথেষ্ট কাশফুলকে দূর থেকে দূরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। সবুজ প্রকৃতি আর নীলাকাশের মাঝে সাদা কাশফুল নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ভাণ্ডার। তাই তো ঋতুরানি শরৎ এলেই কাশফুলের দেখা পেতে ছুটে যান মানুষ দূর-দূরান্ত থেকে। চোখ ভরে কেবল উপভোগই করেন না, ফ্রেমে বন্দি করে নিয়ে যান স্মৃতি হিসেবে। কাশফুলের মাঝে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে হালকা নীল কিংবা লাল রঙের শাড়িতে সাজিয়ে তোলেন তরুণীরা। বাদ পড়ে না উজ্জ্বল যে কোনো রং। খোলা চুল কিংবা খোঁপা আর হাতে কাশফুল, এমন ছবিতেই ফুটে ওঠে তরুণীরা।
যাযাবর মন জমে ওঠে চায়ের পসরায় : ঘুরতে যাওয়ার জন্য কাশবন অন্য এক ভালোলাগার জায়গা। তবে মধ্য দুপুরে তপ্ত রোদের সময় এ জায়গা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। পড়ন্ত বিকালে নরম রোদমাখা ছবি বেশ ভালো আসে অন্য সময় থেকে। এছাড়া যুগলবন্দি ছবি তুলতেও অনেকে বেছে নেন কাশফুল। কেউ কেউ আসেন একটু একান্তে সময় কাটানোর জন্য। পরিবারের সঙ্গেও অনেকে আসেন ছোট সোনামণিদের নিয়ে। এর আশপাশ ঘিরে তাই জমে ওঠে ছোট ছোট চায়ের পসরা। এ কাশফুল মূলত ঋতুকেন্দ্রিক ফুল। শরতের এ সময়টাতেই কেবল এদের দেখা পাওয়া যায়। বেশি চোখে পড়ে চরাঞ্চল, জলাধার কিংবা নদীর ধারে লম্বা সরু পথে। অলস দুপুরে তাই নদীর পাড়ে সময় কাটাতে কাশফুলের সঙ্গ মন্দ হয় না। বিশাল এলাকাজুড়ে কাশফুলের সাদা রং মেঘের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ যেন মাটিতে দাঁড়িয়েই মেঘ ছুঁয়ে দেওয়ার মতো। এ জন্যই হয়তো প্রিয় মানুষকে ফ্রেমবন্দি করা হয় কাশফুলের স্নিগ্ধতার সঙ্গে।
শরতে প্রকৃতির অপূর্ব সাজ : শরতের অনন্য রূপ মানুষ-জাতিকে সব সময় মুগ্ধ করে। এ সময় গাছগাছড়া, বন-বাগান হয়ে ওঠে সজীব-সতেজ। চারপাশের পরিবেশ হয়ে ওঠে প্রাণপূর্ণ ও মনোহরা। ধানখেত হয়ে ওঠে সবুজপ্রান্তর। নদীর ধারে, বিলের কিংবা খালের পাড়ে শরতের মৃদু বাতাসে দুলতে থাকে সাদা সাদা কাশফুল। শিউলি ও বকুল গাছের নিচে শিশিরভেজা দূর্বাঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছানো থাকে সুগন্ধিযুক্ত অসংখ্য শিউলি-বকুল ফুল। এ সময়ে পুকুর-ঝিলে পদ্মফুল ফোটে। হাওর-বিলে ফোটে নানা রঙের শাপলা। ফল হিসেবে হাটবাজারে দেখা মেলে আম, আনারস, পেয়ারা, মাল্টা, আমলকি, জলপাই, জগডুমুর, তাল, অরবরই, করমচা, চালতা, ডেউয়া ইত্যাদি। এসব ফুল-ফলের সুঘ্রাণে বাংলার মানুষ এ সময় আনন্দের জোয়ারে ভাসে। শরতের উপস্থিতিতে বাংলার প্রকৃতি দোয়েল, কোয়েল, চড়ুই ও ময়নার মধুর গুঞ্জনধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। এক কথায়, প্রকৃতি সাজে অপূর্ব সাজে।
শুদ্ধতায় ঘেরা কাশফুলের ঋতু শরৎ : শরতে বিভিন্ন অঞ্চলে শরৎ উৎসব বা শরৎ মেলা হতে দেখা যায়। উল্লাসে মুখরিত হয়ে উৎসবে মাতোয়ারা হয় দুই দেশের বাঙালিরা। শিক্ষার্থীরা এ সময় অনেক আনন্দ করে থাকে। উৎসবের ঋতু শরৎকালে শরতের নানা উৎসব এ সময় মানুষের মনকে আনন্দে ভরিয়ে রাখে।
আকাশে ভেসে বেড়ানো শুভ্র মেঘ, নদী তীরে কিংবা খালপাড়ে মৃদুমন্দ বাতাসে দুলে ওঠা শুভ্র কাশফুল, ভোরে হেসে ওঠা শিশিরভেজা শিউলি-বকুল ফুলের উপস্থিতি; সব মিলিয়ে শরৎ যেন শুদ্ধতার ঋতু। শরতের রাতে মেঘহীন আকাশে জোছনার সৌন্দর্য খুব মনোহর। শরৎকালে জোছনার এই মনছোঁয়া সৌন্দর্য নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যায় না। তবে এটা সত্য, ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে বহুকাল আগে থেকেই এ সময় মানবদেহে বেশ কয়েকটি রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। তার মধ্যে আমাশয়, সর্দি-জ্বর উল্লেখ করার মতো। তবু শরতের ভেতর আনন্দময় একটা ঘ্রাণ আছে; যা অন্য কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।