বাংলার শরৎ প্রকৃতি

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী এ দেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালা করে প্রকৃতি একে একে তার ছয়টি রূপ আমাদের সামনে আনে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতুর পালাবদলের। আমাদের জীবনযাত্রায় এসব ঋতু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতুনির্ভর ফল ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্নবৈচিত্র্যে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে। প্রিয় ঋতুর তালিকায় ভিন্ন মত আছে। তবে সৌন্দর্যের তালিকায় শরতের আলাদা কদর রয়েছে। অন্য যে কোনো ঋতুর তুলনায় এ ঋতুর বৈশিষ্ট্য একটু বেশি ভিন্ন। কবি, সাহিত্যিক, গায়কের খাতায় এ ঋতু নিয়ে নানা সৃষ্টিকর্ম উঠে এসেছে। বারো মাস আর ছয় ঋতু- এই তো বাংলার প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। বাংলা মায়ের নতুন নতুন রূপ তার সন্তানদের মুগ্ধ করে রাখে। এ সময় নাকে ভেসে আসে শিউলি ফুলের মন মাতানো গন্ধ আর নদীর বালুচরে রাশি রাশি সাদা কাশফুল। কবির কবিতার খাতায় নতুন ছন্দ আসে। গায়কের কণ্ঠে নতুন গানের সুর ওঠে। সে সুর ভেসে যায় বহুদূর পালতোলা নৌকার মাঝির কানে। আনন্দে বৈঠা বেয়ে যায় সে।

শুভ্রতার প্রতীক ঋতুরানি শরৎ : শরতে সকাল থেকেই এলোমেলো বাতাসে দুলে ওঠে প্রকৃতি। নীলাকাশের বুকজুড়ে সাদা মেঘের ভেলা রাশি রাশি সাদা তুলার মতো ভেসে বেড়ায়। যেন তারা ঠিকানাহীন। অথবা মেঘগুলো উড়ে বেড়ানোর জন্য শরতের অপেক্ষাতেই ছিল। প্রকৃতি জানান দেয় সাদা মেঘের ভেলায় চেপে শুভ্র কাশফুলের আঁচল উড়িয়ে। শেফালি ফুলের মালা মতিহার বানিয়ে গলায় পরে শরতের আগমন ঘটেছে। সেই সঙ্গে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের শীষ আলতো করে মাথা দুলিয়ে শরতকে আমন্ত্রণ জানায়। ভাদ্র পেরিয়ে এখন আশ্বিন শেষের পথে। শ্রাবণে বর্ষার ঘোর কাটতে অনেকটা সময় লেগে যায়। মধ্য ভাদ্র থেকেই শরতের উপস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যেতে থাকে। আশ্বিন মাসেও শরতের রূপ বেশ ভালোই উপভোগ করা যায়। এর পরই যেহেতু শীতকাল, তাই এ মাস থেকে শীতের আগমনী বার্তা বোঝা যেতে থাকে। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক।

উদারমাখা কমনীয়তার চমক : আকাশে মেঘের সাদা রং আর মাটিতে কাশফুল ও শিউলি ফুলের সাদা রং মূলত শুভ্রতাকে পায়। এ সময় বৃষ্টি মায়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃতি সত্যিই যেন শুভ্র বেশ ধারণ করে। প্রকৃতিতে এখন আশ্বিন মাস। নিয়ম অনুযায়ী এখন শীতের অনুভূতি হওয়ার কথা; কিন্তু তা হচ্ছে না। পরিবেশ বদলাচ্ছে। প্রকৃতিও তার আচরণ পাল্টেছে। মাঝেমধ্যেই বৃষ্টি হচ্ছে। তবে যত যা-ই হোক, শরতের রূপের দেখা ঠিকই মিলছে।

আকাশজুড়ে তুলার মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। শীতকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ক’দিন পরই শরৎ বিদায় নেবে। জলহারা মেঘের দল যখন শুভ্র ভেলায় ভাসতে ভাসতে এলোমেলো এগিয়ে চলে, তখন বোঝা যায় শরৎ এসেছে। এখন এরই মধ্যে শরতেও বৃষ্টি নামছে। তবে তা কিন্তু বর্ষার বৃষ্টি নয়। এটা শরতের বৃষ্টি। বৃষ্টির পরই আকাশ পরিষ্কার হয়ে সাদা মেঘের দেখা মেলে। মাঝেমধ্যে দুর্লভ রংধনুও ওঠে। শরতের উদারমাখা কমনীয়তা, এত নীল, এত সাদা, এত মাখামাখি যে, চমকিত না হয়ে পারা যায় না।

মন চায় কাশবনে হারাতে : কবিগুরু লিখেছেন, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/ আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা/ নবীন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে/ সাজিয়ে এনেছি ডালা- এসো গো শারদও লক্ষ্মী/ তোমার শুভ্র মেঘের রথে/ এসো নির্মল নীলপদ্মে।’ সত্যি যেন বাংলার প্রকৃতি অপরূপ সেজেছে। এর মধ্যে একটি অংশ শরৎকাল। প্রতিটি ঋতুরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। বসন্ত ঋতুর রাজা হলেও শরৎ ঋতু সবার কাছেই অত্যন্ত প্রিয় এবং আদুরে। স্নিগ্ধ এ ঋতুর বৈশিষ্ট্য নিয়ে নদীর পারে কাশফুল মাথা দোলায়। নদীর বুকে জেলে, ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে দুদণ্ড প্রশান্তি এনে দেয় কাশফুল। গন্ধহীন এ ফুলটি সৌন্দর্যে অতুলনীয়। শিউলির মনমাতানো গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশ। রাতের আকাশের তারাগুলোই তো ফুটে থাকা ফুল। প্রকৃতিতে ছোট-বড় আরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে শুধু শরতের আগমনী বার্তায়। শরতের এ পরিবর্তন আর প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়/ লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/ নীলাকাশে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা।’ কেবল কবিগুরুই শরৎ নিয়ে সহিত্য রচনা করেননি, আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামও সাহিত্য রচনা করেছেন। তিনি শরতের শিউলি বিছানো পথে পথিককে আমন্ত্রণ জানিয়ে রচনা করেছেন, ‘এসো শারদপ্রাতের পথিক/ এসো শিউলি বিছানো পথিক/ এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে/ এসো অরুণ কিরণ রথে।’ শরতে শুধু প্রকৃতিতেই পরিবর্তন আসে না, আসে আমাদের মনেও। শরতে চারিদিকে সাদার সমারোহ দেখে মনটা একটু তো উদাস হয় সবারই। পাখি হয়ে আকাশে ডানা মেলতে ইচ্ছা হয় অথবা কাশফুল বনের মাঝে হারাতে ইচ্ছা হয়।

শরতের স্নিগ্ধ আলোয় অঞ্জলি হোক : কখনো প্রেমিকার অঙ্গে শিউলির মালা পরাতে মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী কবি শরতে হারানো প্রেমিকাকে না পেয়ে নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে লিখেছেন, ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ রাতের বুকে ওই/ এমন রাতে একলা জাগি/ সাথে জাগার সঙ্গী কই?’ কবিতার এসব লাইন বলে দেয় শরতের আবেগ কেন সবার মনকে এত দোলা দেয়। শরতের প্রকৃতি আমাদের শেখায় নিজেকে আমিত্ব আর অহংকার থেকে মুক্ত করে প্রকৃতির সঙ্গে বিলিয়ে দিই। এ অহংকার বশ করার ক্ষমতা কেবল শরতেরই আছে। তাই শরতের স্নিগ্ধ আলোয় অঞ্জলি দিই।

লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ও গণমাধ্যমকর্মী