ভাদ্র-আশ্বিন মিলে শরৎকাল। শরতের রূপের তুলনা নেই। শিউলিঝরা সকাল, দূর্বাঘাসে শিশিরের ফোঁটা, নদীতীর বা বনের প্রান্তে কাশফুলের সাদা এলোকেশের দোলা, আকাশের নরম নীল ছুঁয়ে ভাসা শুভ্র মেঘের দল, নৌকার পালে বিলাসী হাওয়া- বাংলার শরতে প্রকৃতির এমনই মনভোলানো দান। শুধু কি তাই! ভেসে বেড়ানো মেঘের প্রান্ত ছুঁয়ে উড়ে চলা পাখপাখালির ঝাঁক, বাঁশবনে ডাহুকের ডাকাডাকি, বিলঝিলের ডুবো ডুবো জলে জড়িয়ে থাকা শালুক পাতা, আঁধারের বুক চিরে জোনাকির রুপালি সেলাই, ঘোরলাগা চাঁদের আলো- কী নেই এ ঋতুর কাছে! শরতের এক আনন্দময় ঘ্রাণ আছে। হয়তো এজন্য বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতিতে শরৎ আসে নববধূর মতো।
আশ্বিনে রাত তাড়াতাড়ি আসে : গ্রীষ্মের দাবদাহ আর বর্ষাকালের অবিরাম বর্ষণের পর এ ঋতু জনজীবনে আসে ভিন্ন চেহারায়, স্বস্তি নিয়ে। প্রকৃতি হয়ে ওঠে স্নিগ্ধ ও মনোরম। দিগন্তবিস্তৃত মাঠে মাঠে তখন কচি ধানের হেলেদুলে কাটানো কৈশোর। এমন সবুজের সমারোহে কবিমন গেয়ে ওঠে, ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা! নীলাকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।’ শরতের রূপটাই এমন, যে রূপে সাধারণের মনটাও ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে। অবসাদগ্রস্ত মনটাতেও নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। তবে শরতের দুই মাসের আবার দু’রকম মেজাজ। কখনও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, কখনো অসহনীয় গরম নিয়ে আসে ভাদ্র। কোথাও কোথাও এ মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। আবার এ ভাদ্রতেও ঝরে অবিশ্রান্ত বর্ষণ। প্রবীণরা বলেন ‘পচা ভাদ্দের’। তবে আশ্বিনে রাত তাড়াতাড়ি আসে। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই ভাদ্র থেকে আশ্বিনের বন্দনাই বেশি করেছেন। পদ্মায় নৌভ্রমণকালে শরতের নীলাকাশ দেখে কবির মন আপনা-আপনি গেয়ে উঠেছে, ‘অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’
বাহারি ফুলের ঋতু শরৎ : প্রকৃতির রানি শরৎ ফুলের ঋতু। শিউলি, বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতীসহ আরও অনেকেই আছে, যারা শরতের সঙ্গী হয়ে মন ভরায় সৌন্দর্যপিপাসুদের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথায়, ‘এসো শারদপ্রাতের পথিক! এসো শিউলি-বিছানো পথে। এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে এসো! অরুণ-কিরণ-রথে।’ হেমন্তকে বলা হয় ফসলের ঋতু। আর শরৎ হলো ফসল সম্ভাবনার। কৃষিনির্ভর বাংলার বুকে প্রাপ্তির আশা জাগিয়ে তোলে শরৎ। কৃষকেরা নবান্নের আশায় দিন গোনেন। তবে শরৎ যেন দিন দিন হয়ে উঠছে বইয়ের পাতার বাসিন্দা। এ মহামারিকালে যখন নাগরিক জীবন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে ছুটছে, যখন রুটি-রুজির সন্ধানে ব্যতিব্যস্ত অনেকে, তখন শরতের অপরূপ বিভা দেখার ফুরসত কোথায়?
হারিয়ে যাচ্ছে কাশফুলের বনতল : শরতে ফ্যাশন হাউজগুলোতে নীল-সাদা রঙের পোশাকের যে আয়োজন প্রতিবছর হতো, তাতেও এক ধরনের ছেদ রয়েছে। তা ছাড়া যে কাশফুল শরতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে, দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সেই বনতল। উঠছে গগনচুম্বী ইমারত। তবে প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যতই আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে রোবটিক করে তুলি না কেন, শরৎ আমাদের ডাক দিয়ে যাবেই। অন্তরের মৃদঙ্গে ঘা দেবেই। তাই মন কেমন করা বিকেলে আমরা ছুটে যাই উত্তরার দিয়াবাড়ি, মিরপুর বেড়িবাঁধ, কেরানীগঞ্জ, মাওয়াসহ শহরতলির কোনাকাঞ্চিতে ফুটে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের কাছে। সাদা-নীল পাঞ্জাবি, শাড়ি পরে কাশফুলের সঙ্গে ছবি তুলি। তুলি ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা মেঘের ছবি। আপলোড দিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। লাইক-কমেন্ট আসে। এভাবে একদিন অলক্ষ্যে বিদায়ও নেয় প্রকৃতির রানি শরৎ ঋতু। অস্ফুট স্বরে আমাদের মন হয়তো বলে ওঠে, ‘আহা, চলে গেল!’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক