মনের মাধুরী বোঝে আশ্বিন

তাবাসসুম মাহমুদ

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হঠাৎ করেই নদীতে আর সেই থই থই পানি নেই। আগের সেই প্লাবনের রেশ তেমন নেই। ভাটার টানের মতো কমে যাচ্ছে নদীর পানি। শুকনো একটা পরিবেশ বিরাজ করছে প্রকৃতিতে। চোখে পড়ছে পানিতে ভাসছে শাপলা। মনটাও হঠাৎ করে যেন ভেসে ওঠে মনের মধ্যে। ওদিকে বৃষ্টি আসে হঠাৎ করে। সত্যিই তো আশ্বিনের টান বোঝা যাচ্ছে। চোখে পড়ছে শিউলি ফুল, কাশফুল। আকাশের সাদা মেঘের সঙ্গে কাশের সাদার মিতালি মানুষের মনের মিতালিকেই যেন প্রগাঢ় করে। আশ্বিন বোঝে প্রকৃত মনের মাধুরী।

ভাদ্র আর আশ্বিনে শরতের বাস : শরতের মধ্যে ডুবে থাকে আশ্বিন। ভাদ্র আর আশ্বিনের মধ্যেই শরতের বসবাস। ভাদ্র শরতের যেসব বিষয় সূচনাপর্বে এনে দেয়, আশ্বিন নিজে তার নিজস্ব আগমনের সময় থেকে তাকে পূর্ণতা দেয়। আশ্বিন শরৎকে পরিপূর্ণ করে। এ দিক দিয়ে আশ্বিন শরতের পরিপূর্ণতার সুহৃদ। আবার অন্যদিকে প্রতিনিয়ত শরতের জন্যও আশ্বিন বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। অর্থাৎ ভাদ্রের সঙ্গে শরতের নিবিষ্টতা প্রগাঢ় হওয়ার আগেই আশ্বিনের আগমন বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায় ভাদ্রের স্বপ্নকে। আর নিজেকে নিবিড় করে তুলতে সদা সচেষ্ট থাকে আশ্বিন নিজেই। কিন্তু সেও খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অল্প সময়ের আগমন, ক্ষণিক পরেই প্রস্থান। কিন্তু তার এ প্রস্থান দ্রুত সত্ত্বেও সে নিজেকে শরতের সুরভিতে জড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়। ধন্য হয় শরৎ। ভাদ্র-আশ্বিনের উদারতায় বিমুগ্ধ প্রকৃতি।

প্রকৃতিতে পরিবর্তনের পূর্ণতা দান : শিউলি ফুলের ফোঁটা, সাদা মেঘ, শান্ত সরোবর নদী, কাশফুল, ভাদ্রের তালপাকা গরম- সব মিলিয়ে শরতের অপরূপ শোভা সত্যিই মুগ্ধকর। গরমের তীব্রতা আশ্বিনে আস্তে আস্তে কমে আসে। কখনও কখনও প্রকৃতি আশ্বিনে কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাদ্রে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আর্দ্রতা বেড়ে যায়। তা সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসে আশ্বিনে। ভ্যাপসা গরমের ভাব অনেকটা কমে আসে। একটি পরিবর্তন প্রকৃতির ভেতর যেমন লক্ষ্য করা যায়, আশ্বিন সেই পরিবর্তনে পূর্ণতা দান করে। নদীর পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকে এ সময়। মাটির সিক্ততাও কমতে থাকে। সেই বর্ষার অবিরাম বর্ষণের ধারা শরতে এসে আর তেমন দেখা যায় না। চারদিকে ক্রমেই শুকনো অবস্থার রূপ পরীলক্ষিত হতে থাকে। একদিকে নদীর পানি কমে, বৃষ্টির পরিমাণ বেশ কমে আসে। অন্যদিকে আকাশের গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা মেঘ আর শরতের পুরোদস্তুর নেমে পড়া প্রকৃতি আনন্দের সুর তোলে হৃদয়ে। এ পরিবেশকে যে যেভাবে উপভোগ করে নিতে পারে।

আশ্বিনের দুয়ারে প্রাণের বার্তা : শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী ফুলের সুরভিতে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রকৃতি। বিলে ঝিলে শাপলা আর নদীর তীরে কাশফুল আশ্বিনের দুয়ারে প্রাণের বার্তা নিয়ে আসে। শরতের পরিবেশকে নির্মল চোখে দেখে সবাই। বাতাসে শীতের স্পর্শ যেন পাওয়া যায় আশ্বিনের ভোরে। শরতের এ নির্মল প্রকৃতি কারই না ভালো লাগে! কবিতায় আমরা আশ্বিনের নির্মল রূপকে দেখি। প্রকৃতির ভারসাম্যহীনতায় ঋতুর পরিবর্তনকে আমরা সত্যি ঠিকমতো ধরতে পারি না। কখন আশ্বিন আসে, আর কখন যায়, শহরে বসে তা বোঝা আরও কঠিন। তবু শরৎ আসে, আশ্বিন আসে। প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে শরৎ উন্মুখর হয়ে থাকে। শরতের শোভা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মনের শোভাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অবশ্য তার জন্য মন থাকা চাই। দু’চোখ মেলে দেখার দৃষ্টি থাকা চাই। দু’ডানা মেলে উড়াল দেয়ার স্বপ্ন থাকা চাই। এর শোভা উপভোগ করতে হলে প্রকৃতির সঙ্গেই আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আমরা যদি তা না করতে পারি, তাহলে প্রকৃতির কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু তাকে যদি আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে বলি, তাহলে প্রকৃতি বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। সেই বিপর্যয় পরিণামে আমাদের বিপর্যস্ত করে তুলবে।

রূপের রানি শরৎ : প্রকৃতি আপন নিয়মে চলে। সেই নিয়মের পথ ধরে এ বাংলায় আসে রূপের রানি শরৎ ঋতু। শরৎ এমন এক পটভূমিতে আসে, যা নতুন ও ভিন্ন। এই তো ক’দিন আগে শিক্ষার্থীদের দুর্বার আন্দোলনে ভেঙে ছত্রখান হলো দীর্ঘদিন ধরে চেপে বসা জগদ্দল পাথরটি। সরকার পরিচালনায় নতুন যে কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, শিক্ষার্থীরাও এর অংশ। তবে ‘রক্তের দাগ শুকোয়নি’। তাই দাবি উঠেছে ন্যায়বিচারের। এমন দিনে বাংলার প্রকৃতিতে এলো মনভোলানো রূপের ঋতু শরৎকাল। কাশফুলের অবারিত স্বাধীনতা, সুনীল আকাশে পেঁজা তুলার মতো আলস্যে ভেসে বেড়ানো মেঘ, পথ হারানো সাদা বকের সারি, মনমাতানো সুখে প্রজাপতি-ফড়িংয়ের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ নাচানাচি, বাতাসে শিউলির তাজা ঘ্রাণ, ধান ক্ষেতে নুয়ে থাকা সোনাঝরা শিষ, নদীর পানিতে ভরা জোছনার ছায়া- এসবই শরৎ ঋতুর চিরচেনা বৈশিষ্ট্য। এবার গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহের কথা ভুলে যাইনি। কী দহনকাল যে কাটিয়েছি আমরা! বর্ষায় এবার অবিরাম বর্ষণ ততটা দেখা যায়নি। তবে আর্দ্রতার অস্বস্তি তো ছিলই।

শরতে শোনা যায় যার পদধ্বনি : কবিরা শুধু শিউলি ফুলের বন্দনা করলেও শরৎ ঋতুতে বসে হরেক ফুলের মেলা। শরৎকালের আনন্দ বাড়িয়ে দিতে আরও ফোটে বেলি, দোলনচাঁপা, বকুল, শালুক, পদ্ম, জুঁই, কেয়া, কাশফুল, মাধবী, মল্লিকা, মালতী। এর বাইরে গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণচূড়া এখনও ফুটে আছে ঢের। রাজধানীর আগারগাঁও, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা, হাতিরঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে কৃষ্ণচূড়া ও সোনালুর উপচানো হাসি দেখা যায়। ভাদ্র ও আশ্বিন শরতের দুই মাসের আবার দু’রকম অবয়ব। কখনও ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি, কখনও অসহনীয় গরম নিয়ে আসে ভাদ্র। কোথাও কোথাও এই ভাদ্র মাস ‘তালপাকা ভাদ্র’ নামে পরিচিত। পাকা তাল অবশ্য বাজারে উঠে গেছে। শুরু হয়ে যাবে তালের পিঠা বানানোর আয়োজন। শরতের দ্বিতীয় মাস আশ্বিনে রাত আসে তাড়াতাড়ি। শীতল হতে থাকে আবহাওয়া। শোনা যায় হেমন্তের পদধ্বনি।

উৎসবের ঋতু শরৎ : শহরের মানুষদের অনেকেই অনেক রকম লোকাচারের সঙ্গে পরিচিত নন। এ দেশে এমনই এক লোকাচারের নাম ‘ভাদর কাটানির উৎসব’। ভাদ্র মাসের প্রথম তিন থেকে সাত দিন নববধূ যদি স্বামীর মুখ দেখেন, তবে অমঙ্গল হতে পারে- এমন বিশ্বাস থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ দিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে যান নববধূরা। এ দেশে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ উৎসব উত্তরবঙ্গের দিকে বেশি হয়, দক্ষিণবঙ্গ বা অন্যান্য স্থানে ততটা নয়। একসময় নববধূরা গরু-মহিষের গাড়িতে চড়ে ভাদর কাটানির উৎসবে বাবার বাড়ি নায়র যেত। এখন যায় মাইক্রোবাস, ইজিবাইকে করে। এ উৎসবের উৎপত্তি সম্পর্কে জানা যায়, ভাদ্র মাসজুড়ে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পুরুলিয়া, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে ভাদু নামক লৌকিক দেবীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গেও বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে প্রচলিত এ উৎসবের সম্পর্ক থাকতে পারে।

শরতের সুখ-আনন্দ গায়ে মাখি : রাজধানীতে কয়েক বছর ধরে কাশফুলের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ তৈরি হয়েছে উত্তরার দিয়াবাড়িতে। বেলা শেষের নরম আলোয় বাতাস সেখানে মৃদঙ্গ বাজায়। বহু নগরবাসী বেড়াতে যান সেখানে। মিরপুর বেড়িবাঁধ, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের মাওয়ার দিকে গেলেও কাশফুলের নরম ছোঁয়া পাওয়া যায়। যাওয়া যেতে পারে শাপলা ফোটা মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলেও। তবে উন্নয়নের বিভ্রমে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতির আনন্দ। হ্রাস পাচ্ছে নাবাল জমি। কাশফুলের ক্ষেত কেটে নিতে হাত কাঁপছে না কারও। এই শরৎ থাকবে না। প্রকৃতির নিয়মে এসেছে, প্রকৃতির নিয়মেই চলে যাবে। আফসোস করার আগে একটু হৃদয় মেলে শরৎকে দেখা যেতে পারে। এই উতাল হাওয়ায় কি অপরূপ সেজেগুজে রয়েছে শরৎরানি! তাতে মনের কাবা খুশি হবে ক্ষণিকের জন্য হলেও।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক