বাংলাদেশের প্রকৃতি খুবই সুন্দর। চারপাশের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি হৃদয়-মন কেড়ে নেয়। অজানা এক ভালোলাগা কাজ করে। প্রকৃতির সৌন্দর্যে? নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। তার মায়ায় মন ভুলে যায় বেদনার মুহূর্তগুলো। ফিরে পায় হারানো স্মৃতি। আল্লাহতায়ালা পরম মমতার সাজে পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন। মনোমুগ্ধকর রূপে তাকে সাজিয়েছেন। তাই আধুনিক কারুকলা ও আর্টশিল্পের চাকচিক্যের রূপ সবুজ প্রকৃতির রূপের সামনে ক্ষীণ ও লঘু। নারীর রূপে পুরুষ যদি হয় পাগলপারা, তাহলে প্রকৃতির রূপে হবে বিস্ময়, বিমূঢ় ও আত্মহারা। কারণ, সবুজের মায়া তো রবের শ্রেষ্ঠ দান। যেখানে সবুজ প্রকৃতির দেখা মেলে না, সবুজের মাঝে তৃপ্তি-প্রশান্তি অনুভব হয় না, তাকে বড় নির্জীব ও শূন্য লাগে। আত্মার শান্তি সেখানে ক্ষুণ্ণ। বস্তুত প্রকৃতি ও তার রূপ আল্লাহর দেয়া অনেক বড় অনুগ্রহ ও নেয়ামত।
প্রকৃতির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা : প্রকৃতিবিহীন জনবহুল এলাকা যেন কারাগারের চেয়ে নির্মম স্থান। প্রকৃতির আছে বৃক্ষরাজি, পশুপাখি, খালবিল, নদীনালা ও পাহাড়-পর্বত; যা মানবজীবনের আবশ্যকীয় অংশ। কারণ, মানবজাতির যেসব অনুষঙ্গ দিয়ে জীবন পরিচালিত হয়, তার মধ্যে অক্সিজেনের প্রভাব ও গুরুত্ব অনেক। আর বৃক্ষরাজি সেই অক্সিজেনের অধিক জোগান দেয়। তা ছাড়া প্রাণীর প্রয়োজনীয়তাও কম নয়। মানুষের খাদ্যসামগ্রীর মধ্যে অন্যতম হলো- বৈধ প্রাণীর গোশত। আর তার জন্য বৃক্ষরাজি ও তার অক্সিজেন থাকা ছাড়া বিকল্প নেই। বস্তুত প্রকৃতির গুরুত্ব মানবদেহের অঙ্গের মতোই অনস্বীকার্য। দিনের শুরুতে পূর্বদিগন্তে কিরণ দেখতে কতই না ভালো লাগে! সূর্যের সেই অনিন্দ্য সুন্দর মনকাড়া দৃশ্য কতই না চমৎকার! প্রকৃতির এ অবদান না হলে মানুষ ভোরে ঐশ্বিক নেয়ামতরাজি কোথাও খুঁজে পেত না। সমাজের যেসব শ্রেণির মানুষ কৃষিকাজে নিবেদিত, তাদের দিন কাটেই প্রকৃতির সেই সুন্দর আলোতে। প্রকৃতির এ সৌন্দর্য না হলে কৃষক হয়তো ফসলি কাজ থেকে হাত গুটিয়ে নিত বহু আগেই। তখন সামাজিক প্রথারীতি হয়তো স্থবির হয়ে যেত। সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো হাজারো মানুষ।
বাংলার প্রকৃতি যে কারণে অনন্য : পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যেখানে প্রকৃতির সব বৈশিষ্ট্য পাওয়া দুর্লভ এবং অসম্ভব প্রায়। প্রকৃতির বড় একটি উপাদান হলো, গাছপালা। পৃথিবীর অনেক স্থানে গাছপালার সন্ধান মেলে না। কোথাও কিছু গাছপালা থাকলেও নেই নদী-নালা। সেখানে মানুষ বৃক্ষরাজির সজীবতায় মুগ্ধ হলেও নদীর ঢেউ দেখতে পায় না, নদীর কল্লোল ধ্বনিতে বিমোহিত হতে পারে না। এর বিপরীতও পরিলক্ষিত হয়। কোথাও সারি সারি পাহাড়-পর্বত প্রকৃতির শোভা বৃদ্ধি করলেও আরো অনেক কিছু থাকে না। আমাদের বাংলার যে প্রকৃতি আমরা প্রতিনিয়ত উপভোগ করি, তার মাঝে কী না আছে? প্রকৃতির শোভাবর্ধক প্রতিটি উপাদানই? আছে এর মাঝে,; যা বিশ্ববাসীর কাছে এ দেশের প্রকৃতিকে করে তোলে অদ্বিতীয়, অনন্য। বাংলার সবুজ শ্যামলের প্রকৃতি আল্লাহর দেয়া অপার নেয়ামত, যা না হলে আমরা বঞ্চিত হতাম বহু কিছু থেকে। বাংলার চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ীই এ দেশ ষড়ঋতুর দেশ। পালা করে প্রকৃতি একে একে তার ছয়টি রূপ আমাদের সামনে আনে। আমরাও অপেক্ষায় থাকি দুই মাস অন্তর অন্তর ঋতুর পালাবদলের। আমাদের জীবনযাত্রায় এসব ঋতু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ফসল উৎপাদন এবং ঋতুনির্ভর ফল ঋতু বদলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ভিন্নবৈচিত্র্যে হাজির হয়। প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে আমাদের মনেও বৈচিত্র্য আসে।
বাংলার প্রাকৃতিক শোভা মুগ্ধ করে : সবুজের চাদরে ঢাকা আমাদের এ দেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক শোভা আমাদের মুগ্ধ করে। এ দেশের প্রকৃতির রূপ বড় বিচিত্র।
এ দেশের নদী, মাঠ, অরণ্য, আকাশ, পাহাড় দেখে আমরা পুলকিত হই। আমাদের মাতৃভূমি তার অপরূপ ঐশ্বর্য ও সম্পদে অনন্য। আমাদের গ্রামের মাঠ-ঘাট, বন ও প্রান্তর সবকিছুর সঙ্গেই আমাদের আত্মার সম্পর্ক। তাই এ প্রকৃতি আমাদের কাছে অন্য সব স্থানের চেয়ে অনেক বেশি আপন। আমাদের চারদিকে সবুজের সমারোহ। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ঘন সবুজ। আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, নারিকেল, বট, শাল, সেগুন, মেহগনি, কড়ইসহ আরও কত গাছ! এসব গাছগাছালি মিলে চারপাশে একটা বনের মতো সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষার দিনে যখন এ বনে বৃষ্টি আসে, তখন মনে হয় প্রকৃতি যেন তার দু’হাত বাড়িয়ে আমাদের ডাকছে।
আবার শীতের দিনে যখন গাছগুলোর পাতা ঝরে পড়ে, তখন প্রকৃতিকে অসহায় মনে হয়। বসন্তে নতুন পাতা এলে গাছগুলো নতুন সাজে সেজে ওঠে। শুধু বড় গাছগুলোই নয়, ছোট গাছগুলোও অপরূপ শোভা সৃষ্টি করে চারপাশে।
বাংলার অপরূপ প্রকৃতি ও পরিবেশ : বনের দিক থেকে চোখ ঘোরাতেই ধানখেত সামনে এসে পড়ে। যখন তার ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যায়, তখন মনে হয় সবুজের সমুদ্র বুঝি হাতছানি দিয়ে ডাকছে। পাটক্ষেতের পাটগাছগুলোও বেশ বড় হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে মনটা আনন্দে ভরে যাচ্ছে। গমখেতের গমগুলো পেকে উঠেছে। তার ওপর যখন সূর্যের আলো পড়ছে, তখন সোনালি আলোয় চারদিক ভরে যাচ্ছে। এ মাঠেই শীতের সময় ফোটে সর্ষেফুল।
তখন চারদিক হলুদ হয়ে ওঠে। মৌমাছির দল এসে তখন সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করে। মাঠ পেরিয়ে রাস্তায় আসতেই একটা বড় পুকুর চোখে পড়ে। পুকুরের চারদিকে নারিকেল ও কলাগাছ লাগানো। পানি কাঁচের মতো স্বচ্ছ। তার এক কোণে ফুটে আছে শাপলা ফুল। মাঝেমধ্যে একটা দুটো মাছ লাফ দিচ্ছে এদিক থেকে ওদিকে। দুটো ছেলে অনেক উঁচু একটা গাছের ডাল থেকে পুকুরের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ঢেউ বয়ে গেল। পুকুরপাড় দিয়ে সামনে আসতেই একটা বিল চোখে পড়ে। বিলে অনেক পানি। জেলেরা সেখানে জাল দিয়ে মাছ ধরছে। বিলের পানিতে হালকা হালকা ঢেউ। তবে বর্ষায় এমন থাকে না। তখন অনেক বড় বড় ঢেউ এপার থেকে ওপার অবধি বয়ে যায়। বিলের ওপরে কিছু নৌকা ভেসে চলেছে। কিছু মানুষ বিলের এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে।
বাংলার আকাশ স্বর্গের লীলাভূমি : গাঙশালিক, বক, বেলে হাঁস, মাছরাঙা ছাড়াও বিলের ধারে রয়েছে আরো অনেক পাখি। রাতে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা মেছোবাঘ বিলের ধারে দেখা যায়। এ ছাড়া সবুজ ধানখেতে ও গাছের মাথায় ছুটে আসে টিয়া, চড়ুই, শালিক, ঘুঘু, বুলবুলি, ফিঙে, দোয়েলসহ আরো অনেক পাখি। ঘন সবুজ গাছের আড়ালে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা শেয়াল দেখা যায়। তবে সাপ, বেজি, বনবিড়াল সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা।
বাংলার রাতের আকাশ দেখে মনে হয়, যেন স্বর্গের লীলাভূমি। অগণিত তারা রাতের আকাশকে উজ্জ্বল করে তোলে। পূর্ণিমার সময় চাঁদের আলোয় ঝলমল করে চারপাশ।
আবার অমাবস্যার রাতে চারদিকে কালো অন্ধকারে ভরে যায়। তখন জোনাকির আলোয় মানুষ পথ চিনে ঘরে ফেরে। প্রকৃতি জেগে ওঠে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। কাকডাকা ভোরে মানুষ ঘুম থেকে উঠে আপন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সারাদিন পর আকাশ রাঙিয়ে যখন সূর্যাস্ত হয়, তখন প্রকৃতির কোলে যে যার স্থানে ফিরে যায়। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি চোখ জুড়ানো ও মন ভুলানো। তাই যে একবার এ প্রকৃতির মাঝে আসে, সে আর এখান থেকে যেতে চায় না। খুঁজতে চায় না অন্য কোনো রূপ। তাই তো কবি বলেছেন, ‘বাংলার মুখ দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’