গ্রামবাংলার মাঠেঘাটে, বাজারহাটে নতুন ধানের, নতুন চালের মণ্ডম রব। বৃক্ষরাজিতে ঝরাপাতার বেদনা-উল্লাস। চারিদিকে হিম হিম শীতের আগমনী ঘণ্টা। মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হলদে-শুকনো চাদর। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কৃষকের ঠোঁটকোণে আজ ঐশ্বর্যের হাসি। বহু শ্রমে এসেছে তার রক্ত-পানি শাসালো শস্য। চোখে তার আনন্দ জল। হৃদয়ে তার পাকা ধানের মিষ্টি ভাবনা। এখানে-সেখানে ধান কাটা-মাড়াইয়ের মহোৎসব। উঠোনজুড়ে ধান ভানার লোকদের ভীড়। বাড়ি বাড়ি বউ-ঝিয়েদের মহাব্যস্ততা। পাড়ায় পাড়ায় কৃষক-কৃষানিরা ব্যস্ত নবান্নের পিঠা পায়েশ তৈরিতে। উৎসবের আমেজ আজ সবুজ বাংলার প্রান্তে প্রান্তে। এ যে ঋতুকন্যা হেমন্তের বার্তা।
হেমন্তের অফুরান নেয়ামত : সবুজের প্রকৃতিতে হেমন্ত নিয়ে আসে নানা উৎসব। প্রকৃতি মেলে ধরে তার ঐশ্বর্য, রূপ-রস, জৌলুস। মাঠে মাঠে ধানে ধানে ফসল ঝনঝনা শব্দে সুর তোলে। কৃষক ব্যস্ত হয় নয়া ফসলের মাড়াইয়ে। কৃষানি ব্যস্ত হয় পিঠাপুলির আয়োজনে। বৃক্ষরাজিতে পত্রবদলের প্রস্তুতির আমেজ চলে। উদোম শরীরে প্রকৃতি অপেক্ষা করে বসন্তের। পাখিদের কণ্ঠে আসে সুরের নয়া লহরি। কোকিল তোলে কুহুকুহু তান। পাপিয়া ডাকে পিউপিউ একতান। দোয়েল-শালিক নয়া ধানের নয়া খড়কুটে বাঁধতে শুরু করে বাসা। চারিদিকে শরতের শূন্যতা, রিক্ততা ও বিষণ্ণতা ঘুচতে থাকে। শরতের বিরহী আমেজে গুমোট একটা ভাব গাছে-নদীতে ও পাখিদের ওড়াউড়িতে। কী যেন ফুরিয়েছে! প্রকৃতি কী যেন হারিয়েছে! হেমন্তের এ আয়োজন বাংলাকে করেছে ধন ধান্য। কৃষককে দিয়েছে মুখ ভরা হাসি। হেমন্তের এ সময় সৌন্দর্যের আবহে মন-প্রাণ ভরে ওঠে। ধানের পাল্লা যখন ভারী হয়, কৃষক অনমনে বলে ওঠে- আলহামদুলিল্লাহ। ক্ষির-পায়েশে মেহমান খুশে হলে বাড়ির বউ-ঝিয়েরা বলে ওঠে- আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যে বীজ বপন করো, সে সম্পর্কে চিন্তা করেছ? তোমরা কি সেটাকে অংকুরিত করো নাকি আমি আল্লাহ অংকুরিত করি? আমি ইচ্ছা করলে এটাকে খড়-কুটোয় পরিণত করতে পারতাম; তখন তোমরা হা-হুতাশ করতে।’ (সুরা ওয়াকিয়া : ৬৩-৬৫)।
বিচিত্র প্রকৃতি আল্লাহর নেয়ামত : প্রকৃতিতে ঋতুকন্যা হেমন্তের আগমনে শরতের প্রত্যাগমন হয়। শুরু হয় শীতের আয়োজন। ফসলের ঝাল-টক-মিষ্টতা, কাঁচা-পাকায় স্বাদের ভিন্নতা, বর্ষা-শীতের বৈরিতা সবই আল্লাহর নেয়ামত। প্রকৃতির এ পরিবর্তনের কারণেই মাঠে ধান আসে, পুকুরে মাছ আসে, গাছে ফল আসে, আসে মানুষের জীবনে সুখ-দুঃখের হেমন্ত বসন্ত। প্রকৃতির এমন দ্বিচারিতা না হলে ফলবান হয় না গাছ, নদীতে আসে না জোয়ার, খালবিলে ফোটে না শাপলা-শালুক। নবজন্মের প্রস্তুতি নিতে পারে না প্রাণীকুল। সঙ্গে সঙ্গে এ পরিবর্তনে রয়েছে মানুষের জন্য বিশাল শিক্ষা-উপাদান। নিজেকে পরিবর্তন করার সমূহ আয়োজন রয়েছে প্রকৃতির এ বদলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত-দিনের পরিবর্তনে, মানুষের কল্যাণে সমুদ্রে চলা নৌযান, আল্লাহ আকাশ থেকে বৃষ্টির পানি বর্ষণের মাধ্যমে যে মৃত জমিনকে পুনর্জীবিত করেন তাতে এবং তাতে জীব-জন্তুর বিস্তারণে, বায়ুর দিক পরিবর্তন, আকাশ ও ভূপৃষ্ঠের মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালায় জ্ঞানী জাতির জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা বাকারা : ১৬৪)।
ফুলে-ফলে টইটম্বুর প্রকৃতি : বর্ষার পানিতে শরতের কাঠফাটা রোদে প্রকৃতি কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ে। চারিদিকে ফুল শূন্য ফলবিহীন উদোম বৃক্ষচর। মাঠে নেই কৃষষের ব্যস্ততা। গোয়ালে নেই রাখালের কর্মযজ্ঞ। তবে যখন ঋতুকন্যা হেমন্ত আসে, রূপ-ফল আর ফসলের সঙ্গে বাড়ে প্রকৃতির ব্যস্ততা। ধান কাটায় মত্ত হয় কৃষক।
খেজুরের রসের জন্য প্রস্তুত হয় গাছিরা। প্রকৃতি নিজেকে নতুন সাজে মাঠ পাকা ফসলের শাড়িতে নববধুর ঘোমটা ঘোচায় সলাজে। ভোরে হালকা কুয়াশার চাদর ভেদ করে ঘাসের ডগায়, ধানের শীষে, পাতায় পাতায় সোনালি কিরণ মুক্তোর আলো বিলায়। দিগন্ত বিস্তৃত কাঁচা-পাকা ধানের সবুজাভ হলদে আভায় একাকার চারিদিক। ভোরের আলো বাতাসে ফুটতে থাকে গন্ধরাজ, মল্লিকা, শিউলী, কামিনী, হিমজুরি, দেব-কাঞ্চন, রাজ আলোক, ছাতিম, বকফুল। প্রান্তে প্রান্তে হলদে কোটার গান। বিকেলে নরম কুয়াশা, সন্ধ্যার আবছা আলোয় ঝিঁঝিঁ পোকার মিটিমিটি বাতি মুগ্ধকর একটি পরিবেশ। ঝিরঝির শীতল সমীরণ ঢেউ তুলে যায় পাকা ধানের শীষে। মাঠজুড়ে মাষ কলাই ধান, গমের শুকনো ঘ্রাণে বিমোহিত। খালবিল থেকে নামতে থাকে বর্ষার অবশিষ্ট জলরস। সন্ধ্যার আকাশে তেমন একটা জোনাকির দেখা মেলে না। বাঁশি হাতে রাখাল ফেরে একপাল পশু নিয়ে। স্বপ্নীল এক জগৎ হাতছানি দিয়ে ডাকে। শীতের আগমনী বার্তা পৌঁছাতে থাকে প্রকৃতির গভীর থেকে গভীরে। রস-কষহীন পাতারা বিষাদ যাতনায় ঝরে পড়ার প্রস্তুতি সারে অতি সন্তর্পনে। আর শেষ রাতে একটা মিষ্টি শীতের পরিবেশ সবাইকে জড়িয়ে ধরে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমের গভীরে ভেসে আসে মুয়াজ্জিনের সুমধুর আল্লাহু আকবার ধ্বনি। অসলতার অক্টোপাসে আটকে যায় অনেক ঘুমকাতর মুসল্লি। কিন্তু আল্লাহর ভয়ের দাপুটে আল্লাহপ্রেমের আলোতে অনেকে আবার সেই শীত-ভোরের কাঁথায় লাথি মেরে উঠে যায় সহজে। আবছা কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছোটে মসজিদের দিকে। হেমন্তের শীতমিশ্রিত ঠান্ডা বায়ু শরীর ও মনে হৈমন্তিক বারতা পৌঁছে দেয়।
যে উৎসবে আল্লাহ নারাজ : ঋতুকন্যা হেমন্ত গ্রামবাংলার পাড়ায় পাড়ায় নিয়ে আসে বেশ কিছু উৎসব-পালা-পর্বণ। সে উৎসবগুলোতে থাকে গ্রাম্য সংস্কৃতির কিছু সরল আয়োজন। এ আয়োজনগুলো মূলত বাংলার রূপ-প্রকৃতিরই অংশ। সুন্দর আয়োজনগুলোর সঙ্গে সঙ্গে কিছু অসুন্দর আয়োজনও ঢুকে পড়ে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে, নবান্নের নব উৎসব আমেজে আমরা যেন অস্ন্দুর কোনো আয়োজনে জড়িয়ে না পড়ি। নবান্নের উৎসব-আমেজের সব উৎসবে মাতানো যাবে না। এগুলোর সবগুলো করাও যাবে না। ঈমান বাঁধ সাধবে। যাত্রা ও পালাগান, নাটক-কৌতুক, নাচানাচি থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করতে হবে। যা শরিয়তের সুন্দর সীমা ক্রস করে ফেলে। খেলাগুলো যেন সময় ও নামাজ নষ্টের আয়োজন না হয়।
হেমন্ত যেমন ফসল দিয়ে কৃষকের চোখমুখ ভরে দেয়, সেই হেমন্তে শোকরগোজারি ও কৃতজ্ঞতার পালাও ভরে নিতে হবে। যদি হেমন্তকে শোকরিয়ার সঙ্গে গ্রহণ করি, আল্লাহ এমন ফুল-ফসল ভর্তি হেমন্ত দেবেন বারবার। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘তোমরা কৃতজ্ঞ হলে অবশ্যই আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব। আর অকৃতজ্ঞ হলে নিশ্চয় আমার শাস্তি তো কঠোর।’ (সুরা ইবরাহিম : ৭)। আয়াতটির বার্তা হেমন্তের মতোই সরল। যদি তোমরা ধান, কলাই, মাষ, গমের মণ্ডম ঘ্রাণে শোকরের তসবিহ না জপো, তাহলে আগামী হেমন্তে খালি মাঠে রিক্ত হস্তে কষ্ট-বেদনায় ফিরবে।
হেমন্তের ছোঁয়া লাগুক জীবনে : শরতের পরে হেমন্ত। হেমন্তের পরে শীত। ঠিক এ গতিতেই আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসে। কৈশোরের হাসি-উচ্ছলতা পেছনে ফেলে তারুণ্যের বিহ্বলতা, যৌবনের তেজোদ্দীপ্ত সময় মাড়িয়ে প্রৌঢ়তা। প্রৌঢ়ত্বের টানাপোড়েন কাটাতে না কাটাতেই বয়সের ভার; যেমন হেমন্ত শেষ হতে না হতেই শীতের আগমন।
জীবনের বাঁক পরিবর্তনের প্রতিটি ভাজে ভাজে ঈমানের ফসলে নবান্ন আসুক। আমলের জৌলুস উতলে উঠুক প্রতিটি শরত-হেমন্তে, শীত-বসন্তে। প্রতিটি বাঁক ঘুরে দাঁড়াক আগের বাঁকের চেয়ে আরও বেশি শুদ্ধতার ঋদ্ধতায়। যেমন নতুনের উল্লাসে পিউ পাপিয়া ডাকে শাখে শাখে, তেমন করে হেমন্তের ছোঁয়া লাগুক জীবনের বাঁকে বাঁকে।