পৃথিবী অপূর্ব সুন্দর। সৌন্দর্যের বৈচিত্র্য পৃথিবীকে করেছে আকর্ষণীয়। মানুষ পৃথিবীর অনবদ্য রূপের স্বাদ পেতে ছুটে যায় দেশ থেকে দেশে। কখনও সেই সৌন্দর্য হয়ে ওঠে বর্ণনাতীত। মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে যায়, মন আপ্লুত হয়ে ওঠে। অবিশ্বাস্য কিছু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। কোথাও সমুদ্র তীরে তারার দল নেমে আসে, কোথাও রক্ত লাল ঝরনা ছুটে যায়, কোথাও আবার আকাশ ছোঁয় রঙিন আলোর ঝলকানি। সেসব দেখে অবলীলায় বলতে হয়- কী অপরূপ সৃষ্টি আল্লাহর!
প্রাকৃতিক আয়না : পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক আয়নাখ্যাত স্থানটি রয়েছে বলিভিয়ায়। দৃশ্যত এখানে আকাশ ও মাটি মিশে গেছে। একে কী বলা যায়, শুধু বিস্ময়? না। পৃথিবীর নান্দনিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব নমুনা প্রাকৃতিক আয়নাখ্যাত ‘সালার দে ইউনি’। আদতে এটি সমতল লবণের খনি। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে এটি। দৃশ্যত আকাশ ও মাটি কোনোটাই নেই এখানে। এমনভাবে আকাশের প্রতিচ্ছবি স্বচ্ছ লবণ সমতলে এসে পড়েছে, দ্বিধায় পড়ে যায় মন। বুঝতেই পারা যায় না, কোনটি সত্যিকারের আকাশ। এ অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যের আধার রয়েছে বলিভিয়ায়। বিশ্বের লাখো পর্যটক অনিন্দ্য সুন্দর এ বিস্ময় উপভোগ করতে ছুটে আসে এখানে। পৃথিবীর আয়না বলিভিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় ১০, ৫৮২ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। আনুমানিক ৪০, ০০০ বছরের পুরোনো লেক মিনচিন। এটি প্রধানত শুকনো ও ভরাট একটি মৃত লেক হয়ে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এই লেকের শুকনো অংশে রয়েছে প্রচুর লবণের স্তূপ। গবেষকদের মতে, এখানে জমে থাকা লবণের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন টন। তবে এর মধ্যে ব্যবহারযোগ্য রয়েছে মাত্র ২৫, ০০০ টন। লেকের স্বচ্ছ পানিতে প্রকৃতির পুরো চেহারায় আয়নার মতো ভেসে ওঠে। পৃৃথিবীর লিথিয়ামের প্রায় ৫০-৭০ ভাগ মজুদ রয়েছে।
জলতলে বন : পুরো বন পানির নিচে ডুবে আছে। এ অভাবনীয় বনটি রয়েছে কাজাখাস্তানে। তিয়ান শান পর্বত ঘিরে থাকা বনটি আলমাটি শহর থেকে প্রায় ১২৯ কিলোমিটার দূরে। ১৯১১ সালের ভয়ঙ্কর এক ভূমিকম্পের পর এ লেকটি তৈরি হয়। আশপাশের পাহাড় ধ্বসে বসে যায় পুরো অঞ্চলটি। এখানে থাকা বন চাপা পড়ে পাহাড়ের নিচে। লেকের পানি এসে ডুবিয়ে দেয় পুরো এলাকা। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে ওঠে বনটি। জলের তলে বনের বিস্তার যে কারও চোখ ধাঁধিয়ে দেবে। এই লেকের পানি ভীষণ ঠান্ডা। কখনোই ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরোয় না, এতটাই ঠান্ডা। শীতকালে পুরো বন ও লেক বরফে ঢেকে যায়।
রক্তিম ঝরনা : রক্তের রং লাল। সেই লালের ধারা বইছে অ্যান্টার্টিকায়। অবিশ্বাস্য এই ‘রক্ত স্রোত’ বিশ্বের আর কোথাও নেই। অ্যান্টার্টিকায় এই লাল টকটকে ঝরনা নিয়ে বহু প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কৌতূহল ছিল। একসময় একে ঘিরে তৈরি হয়েছে বহু মিথ। অনেকে এটি রাক্ষসের নগরী বলে মানতেন। তবে আধুনিক বিজ্ঞান সেই মিথ ভেঙে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন, এই রক্তের মতো লাল জলের ঝরনার পেছনে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত আয়রনের উপস্থিতি। ১৯১১ সালে এই রক্ত ঝরনা আবিষ্কৃত হয়। ঝরনাটি প্রায় পাঁচ ধাপে নেমে এসেছে বলে একে পাঁচতলা ঝরনাও বলা হয়।
অবিশ্বাস্য গিরিখাত : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলঙ্কার হিসেবে ধরা হয় গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন গিরিখাতকে। এখান থেকেই বয়ে যেত খরস্রোতা কলোরোডা নদী। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন প্রায় ২৭৭ মাইল বা ৪৪৬ কিলোমিটার লম্বা। আর কিছু কিছু জায়গায় এ গিরিখাত প্রায় ১৮ মাইল বা ২৯ কিলোমিটার পর্যন্ত চওড়া। এই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরতা প্রায় এক মাইল বা ৬০০০ ফুট। এ গিরিখাত কোনো কোনো জায়গায় ১.৬ কিলোমিটার গভীর, আবার ২৯ কিলোমিটার প্রশস্ত। এ প্রকাণ্ডতাই এটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম গিরিখাত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। গিরিখাতটি একসময় পানির নিচে ছিল। এর জন্ম প্রায় দুই বিলিয়ন বছর আগে।
আলোর স্তম্ভ : বিশ্বের অন্যতম দৃষ্টিনন্দন বিস্ময় আলোর স্তম্ভ বা লাইট পিলার। পুরো আকাশজুড়ে একাধিক আলোর স্তম্ভ মাটি থেকে আকাশ ছুঁয়েছে, এই চোখ ধাঁধানো দৃশ্য ধরা পড়ে মস্কোতে। এ আলো ছুটে আসে সূর্য বা চাঁদ থেকে। লম্বালম্বিভাবে সেই আলো আকাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। স্বচ্ছ আকাশে এ দৃশ্য মানুষকে হতবাক করে দেয়। এ অভাবনীয় দৃশ্য দেখতে মস্কোতে প্রতি বছর লাখো মানুষ জড়ো হন। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় এ আলোর পিলারগুলো বেশিরভাগ দেখা দেয়। পুরো শহর আলোকিত হয়ে ওঠে এ পিলারগুলোর আলোতে। বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়েই এ আলোর পিলারগুলো ভেসে ওঠে।
মেরুজ্যোতি অরোরা : অনেকে বলেন, মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভা। অরোরা মেরু অঞ্চলের আকাশে বাহারি আলোকছটা। বায়ুমণ্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সঙ্গে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জিত কণিকাসমূহের সংঘর্ষের ফলেই অরোরা তৈরি হয়। বিভিন্ন রঙের অরোরা সৃষ্টি হতে পারে। মেরুজ্যোতির রং নির্ভর করে কোনো গ্যাসীয় পরমাণু ইলেক্ট্রন দ্বারা উদ্দীপ্ত হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় কত শক্তি বিনিময় হচ্ছে তার ওপর! সবচেয়ে স্পষ্ট অরোরা দেখা যায় আলাস্কা, কানাডা এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অঞ্চলে। কানাডিয়ান সীমান্ত ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর সীমায় কয়েকবার অরোরা দেখা যায়।
আগ্নেয়গিরির বজ্রপাত : বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৫৫০টি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এসব জীবন্ত আগ্নেয়গিরি। এরা প্রায়ই জেগে ওঠে। আর জেগে উঠলেই ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। বিশ্বে অনেক আশ্চর্যজনক আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যেগুলো তাদের ভয়ানক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। আগ্নেয়গিরির ভয়ানক রূপ অগ্ন্যুৎপাত হলেও বিস্ময় জাগায় আগ্নেয়গিরির বজ্রপাতের দৃশ্য। পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্যজনক ও ভয়ংকর এক দৃশ্য এটি। অগ্ন্যুৎপাতের সময় গলিত পাথরের সঙ্গে ছাই, ভলকানিক কোলাইড তীব্র বেগে ছুটে আসে। তখনও সৃষ্টি হয় কালো মেঘ। আগ্নেয়গিরি চূড়াতেই প্রলয়ঙ্করী বজ্রপাত ঘটে।
তারার সাগর : মালদ্বীপের এ দ্বীপ পৃথিবীর অন্য সব দ্বীপগুলোর মতো নয়। কারণ, সূর্য ডুবতেই এ দ্বীপের সমুদ্রতট ভরে ওঠে আলোয়। দেখে মনে হয়, আকাশ থেকে তারা খসে পড়ছে এই সমুদ্রে। আর সমুদ্র ঢেউ সেই তারাগুলো ভাসিয়ে এনে জড়ো করছে তীরে। তাই একে বলা হয়, তারার সাগর। সমুদ্রের নীল ঢেউয়ে ভাসতে থাকা এ তারাগুলো আসলে জৈবিক আলো। এগুলো ক্ষুদ্রাকৃতির প্লাঙ্কটন। যেগুলো রাতের আঁধারে জ্বলজ্বল করে। সামুদ্রিক প্লাঙ্কটনগুলো নীল রঙের দ্যুতি ছড়ায়। বায়োলুমিনেস বলে এদের ডাকা হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রে এ জ্বলজ্বলে প্লাঙ্কটনগুলো ডায়নোফ্ল্যাগরেটস প্রজাতির।
সাতরঙা ইউক্যালিপটাস : রংধনু বা সাতরঙা ইউক্যালিপটাস প্রকৃতির মন মাতানো বিস্ময়। প্রকৃতিতে নানা প্রজাতির গাছ রয়েছে। ইউক্যালিপটাস হিসেবে সাতরঙা গাছ একটিই রয়েছে গোটা পৃথিবীতে। এটি বেশ লম্বা হয়। এ বিশেষ রংধনুওয়ালা ইউক্যালিপটাস শুধু দেখা যায় নিউ ব্রিটেন, নিউগিনি, কেরাম, সুলাওয়াসি এবং মাইন্ডনোতে। একাধিক রঙের গাছ হিসেবে এর খ্যাতি বিশ্বজোড়া। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদেরও মুগ্ধ করেছে গাছটি। গাছটির বাকলে রঙের ছড়াছড়ি। বাইরের বাকলে এত রঙের ছড়াছড়ি হলেও বাকল ছাড়ালে ভেতরে গাঢ় সবুজ কাণ্ডের দেখা মেলে। তবে এর ভেতরে নীল, গোলাপি, কমলা আর মেরুন কাণ্ড।