প্রকৃতির মনের বদল, শরীরের বদল, ভাবের বদল, প্রভাবের বদলই ঋতু। ঋতু আবার খুব খেয়ালি গ্রাম্যকিশোরী। কাকন হাতে, নূপুর পায়ে, চুলে বেণী গেঁথে মেঠোপথ ধরে চপল পায়ে দৌড়ে চলে। চঞ্চল তার গতিবেগ। নিটোল তার হাবভাব। ভাবের পালে বাতাস দোলায় তার মনের মতো। নাগরদোলার মতো দুলে দুলে ঘুরতে থাকে। আনন্দময়ীর আনন্দগীত যেন ছিটে ছিটে পড়ে বিন্দু বিন্দু শিশির ফোঁটার মতো। যেখানেই পড়ে, সেখানেই ছড়িয়ে যায় আলতো করে। রুপার বর্ণের মতো একটা রং হেসে ওঠে ঠিক শিশুর হাসি যেমন। কখনও এ হাসি অট্টহাসি, কখনও মুচকি, কখনও রোদেল হাসির মতো সোনা-রং-ধরা। ষড়ঋতুর এ দেশে শরৎ শেষে আসে হেমন্ত। মধ্য দুপুরের রোদের তেজ কমে পৌঢ়ের শান্ত, ধীর পায়ের বিকেল নামে। বিকেলে উত্তর থেকে তিরতির করে আসে বাতাস। বাতাসের গায়ে সামান্য হিম। টানটান শরীরে চটচট অনুভূতি। ঠোঁট ফাটার চিনচিন ব্যথা। সন্ধ্যা আসতেই চকচক কৃষ্ণকলির বদলে একটা নেতানো কালো জেঁকে বসে। পাতায় জমা ধুলোর মতো চারপাশটা মলিন ময়লা বদনে ঘরের কোণে আশ্রয় নেয়।
মাঠজুড়ে হলুদ রঙের ধান আর ধান : প্রকৃতি রঙ বদলায় তার নিজস্ব নিয়মে। প্রকৃতির পরতে পরতে কত বিচিত্র রঙ যে মিশে আছে, চোখ খুলে দেখলে, মনের গহীনে উপলব্ধি করলে প্রাণ জুড়ায়। বারবার প্রকৃতি তাই বিশ্ব চরাচরে এক রহস্যের নাম। বিশেষ করে, বাংলা ঋতুর বহু বিচিত্র রূপ-রস-গন্ধ মুগ্ধ করে। এক অভাবনীয় রূপ-বিভায় বাংলার ঋতু-প্রকৃতি প্রতিটি বাঙালিকে ভাবালুতায় নিমজ্জিত করে। অনাদিকাল থেকে চলে আসছে এ প্রক্রিয়া। হেমন্ত ঋতুতে প্রকৃতি ও মানুষের রূপ বদল বড় অপূর্ব। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে কেবল হলুদ রঙের ধান আর ধান। দলে দলে মানুষজন সেসব ধান কাটে। সেসব ধানের আঁটি বাগের দুই পাশে দাঁড়িপাল্লার মতো ঝুলিয়ে বাগ কাঁধে বাড়ি ফেরে। কোথাও বা সেসব ধানের আঁটিবোঝাই গরুর গাড়ি মেঠোপথে ক্যাচর ক্যাচর শব্দ তুলে গৃহস্থের বাড়ি বা ধানখোলার পথে চলে। ভোর থেকে হেমন্তের কুয়াশা নামে মাঠে। বিন্দু বিন্দু শিশির জমে ধান গাছের বুড়ো পাতায়। ক্ষেতের ওপর ওড়াউড়ি করে ফড়িংয়ের দল। সোনালি ধানের ক্ষেত ডিঙিয়ে পূর্ব দিগন্ত রাঙিয়ে ওঠে ভোরের সূর্য। হালকা শীত শীত ভোরের ভেতর মিষ্টি রোদের ওম, কি যে ভালো লাগে!
শীতের অনুষঙ্গরা দেখা দেয় ধীরে ধীরে : হেমন্তে নানা ধরনের উৎসব-পার্বণে গ্রামবাংলার জীবন মুখরিত থাকে। ভেজা ভেজা একটা কুয়াশা-চাদর মুড়িয়ে যায় নিবিড়ভাবে। পথের মানুষরা কাজের ফিরিস্তি ফেলে চায়ের দোকানে আড্ডায় বসতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। গভীর গ্রামে কৃষাণিরা গরম কাপড় গায়ে জড়িয়ে গৃহকাজে মন দেয়। দিনের আলো সংক্ষেপিত হওয়ায় প্রাকরাতে সেরে নেয় আরও কিছু হাতের কাজ। বালক-বালিকারা সেন্টু-গেঞ্জি ছেড়ে নামায় ফুলহাতা জামা। সন্ধ্যা বাড়ে। রাত ঘনায়। বৃক্ষের পাতা বেয়ে টিনের চালে টপটপ করে পড়ে শিশির। শব্দ হয়। কুয়াশা ঘন হয়। শিশির জমে মাঠের ঘাসে। শীতের অনুষঙ্গরা দেখা দেয় ধীরে ধীরে। হেমন্ত শীতের পূর্ব ঋতু। পূর্বাভাস দেখা দেবে এটাই সত্য। সে স্বাভাবিকতায় প্রকৃতিজুড়ে নমনীয় একটা রূপ জেগে ওঠে ভিন্ন রূপে। যে রূপ শরতের নেই, নেই বর্ষার। হেমন্তের রূপ স্বতন্ত্র। অরূপ এক রূপ। প্রশান্তির রূপ। ভাদ্রের কাঠফাটা রোদের অতিষ্ঠতার শেষে হালকা হিমের নরম এক রূপ। হিমঝুড়ি ফুলের এক রূপ। এ রূপকে কাগজে লিখে, মুখে বলে, ছবির ফ্রেমে দেখিয়ে, চিত্রের পটে এঁকে, নাট্যের বর্ণনায় ব্যাখ্যা করা যায় না।
ফুলে-ফলে হেমন্ত সাজে ভিন্ন অঙ্গ শৈলীতে : ধানের ঋতু, সে নয় একমাত্র পরিচয়। ফুল-ফলেও হেমন্ত অন্য ঋতুর চেয়ে আরেক অঙ্গ শৈলীতে সাজে। তার রয়েছে আপন বৈশিষ্ট। যা অন্যের থেকে আলাদা। যা হেমন্তকে চিহ্নিত করে নিজস্বতায়। বকফুল, ছাতিম, রাজ অশোক, শিউলি, কামিনী, মল্লিকাসহ আরও কত যে নাম না জানা সতেজ ফুলের গন্ধে ভরে হেমন্ত, তা অনুচ্চারিত। ফলে তাকেও চেনা যায় তার মতো করে। সজিব ফসলে ভরে ওঠে মাঠ। টাটকা সবজিতে সবুজ হাসি হাসে খোলা প্রান্তর। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই শুদ্ধতার পরিবেশ। দীর্ঘ বেঁচে থাকার আহ্বান। বাতাসে জীর্ণতা, ধুলায় মলিনতা, গায়ে-গতরে বার্ধক্যের রেখা দেখা গেলেও বসবাসে খুব নাতিশীতোষ্ণতায় একটা প্রাণ যেন জেগে ওঠে ক্লান্তিময়তায়। ঝরঝরা এক ভাব যেন অবয়বে। ক্ষুদ্র দিনের আকাশ মেঘমুক্ত এক বিছানা। আধো সাদা মেঘ কোদালি ঢঙে ভেসে বেড়ায় নিজস্ব ছন্দে। কোথাও থাকে, কোথাও থামে না। শীতের মতোই ধীর লয়ে চলে। রোদের কোমলতায় মেঘও মিশে থাকে ঊর্ধ্বাকাশে। এ ঋতুতে কোনো গাঁয়ে হালকা কাঁপন দিয়ে শীত নামে; আবার কোনো কোনো গাঁয়ে ভারী কুয়াশা ঘিরে থাকে জমির উদ্যান। যেখানে বৃক্ষের সমাগম, যেখানে লতাপাতার জঙ্গল, যেখানে ঘাসের জমিন, যেখানে খোলা প্রান্তর, যেখানে খালি মাঠ, যেখানে সবুজের আধার- সেখানে হেমন্তের সত্যি রূপ দেখা যায় মন ভরে। সেখানে হেমন্তচিত্র নামে আসল রূপ নিয়ে। নগরায়ণে এ ঋতু শুধু নয়, কোনো ঋতুর চিত্রই ধরা দেয় না। বেলা-অবেলায় কিছুটা আঁচ করা যায় মাত্র।