প্রাকৃতিক লীলাভূমি মৌলভীবাজার
আবদুল হাই ইদ্রিছী
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
চলছে হেমন্তকাল। কিছুদিন ধরে ভোর রাতে গায়ে চাদর বা কাঁথা না নিলে চলছে না। সিলিং ফ্যানটার গতিও কমাতে হচ্ছে প্রতিদিন। আর ক’দিন পর ফ্যান হয়তো আর চালানোই যাবে না। বাংলাদেশে শীত এক পা দিয়েছে। এবার সবার অপেক্ষা, তার আরেক পায়ের। শীত আমরা ভালোবাসি। আমাদের দেশে শীতকাল অতিথির মতো। অল্প কয়েকটা দিনের জন্যই সোয়েটার পরা, লেপের তলে যাওয়া আর চুলোয় পানি গরম করে হাত-মুখ ধোয়া। এরপর সারা বছর তো ঘামতেই থাকা। ১০-১৫ দিন আগে থেকেই বাতাসে শীতের ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছিল। শীতকে পাকাপোক্ত রূপ দেয়ার জন্য পিঠা বিক্রেতারা রাস্তায় শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলা শুরু করল। এদিকে টং দোকানেও চায়ের বেচাবিক্রি বেড়েছে। শীতবিলাসীরা ভ্রমণের পরিকল্পনা শুরু করছে। আরেকটু শীত পড়লেই শুরু হবে রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি কিংবা সিলেটের উদ্দেশ্যে বাস বা ট্রেনে চড়ে বসা। মানবমন সর্বদা মুক্তি পিয়াসী, চিরচঞ্চল। অবকাশ পেলেই মানুষ ছুটে যায় দিগদিগন্তে সৌন্দর্যের আকর্ষণে। জন্মগতভাবে মানুষ কৌতূহলী। তার সে কৌতূহল নতুন নতুন বিষয়ে। প্রকৃতি ও মানুষের সৃষ্ট সৌন্দর্যের নানা নিদর্শন সে মানবীয় সত্তা দিয়ে অনুভব ও উপলব্ধি করতে চায়। এ শীতে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি এক আকর্ষণীয় পর্যটন নগরীর সঙ্গে। যেখানে দীর্ঘ পথজুড়ে সবুজ গালিচা বিছিয়ে আছে সারি সারি চা বাগান। চা কন্যারা নিপুণ হাতে দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ি সংগ্রহ করে ঝুলিতে ভরছেন। এরই মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ছায়াবৃক্ষ। তাতে হয়তো শিষ দিচ্ছে নানা রূপরঙের সুরেলা পাখি। পিচঢালা পথে চলতে চলতে স্বর্গীয় অনুভূতি ছুঁয়ে যাবে। এমনই এক অপার মায়াবী সৌন্দর্যের লীলাভূমির নাম মৌলভীবাজার।
প্রকৃতি যেখানে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় : বর্ষায় অথৈ জল, শীতে পাখির উল্লাস, বছরজুড়ে উদ্ভিদণ্ডপ্রাণীবৈচিত্র্য নিয়ে দূরের মানুষকে কাছে ডাকে এ জেলা। একদিকে বিশ্বের বৃহত্তর হাওর হাকালুকি। সঙ্গে দেশের অন্যতম বৃহত্তম হাওর কাউয়াদীঘি আর বাইক্কাবিল খ্যাত হাইল হাওর। যেটি হাজারো পাখির কলতান, মাছ ও জলজ উদ্ভিদের আধার। আবার কোথাও গহীন অরণ্য; পাহাড়, নদী, সমতল। মিশ্র চিরহরিত বন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কিংবা গগন টিলা; মাধবকুন্ড কিংবা হামহাম জলপ্রপাত; কোথাও লেক কিংবা পাহাড়ি ঝরনা; পাখিবাড়িসহ নয়নাভিরাম প্রকৃডু। যেন পরতে পরতে সাজানো প্রকৃতির রূপকন্যা; উদ্ভিদ জীববৈচিত্র্যের সম্মিলন। এক মার্কিন ফটোগ্রাফার এ প্রকৃতিকন্যা সম্পর্কে বলেন, মৌলভীবাজার হলো দক্ষিণ এশিয়ার এমন একটি জেলা, যেখানে রয়েছে জীববৈচিত্র্য আর প্রকৃতির অপূর্ব সমন্বয়। যা দ্বিতীয়টি আর নেই। ময়না, শ্যামা, ধনেশ, ঘুঘু, বনমোরগ, হরিণ, বামন মাছরাঙা, প্রজাপতি, সবকিছু রয়েছে এর প্রকৃতিতে। প্রকৃতিঘেরা এ অঞ্চলটি পর্যটকদের মোহাবিষ্ট করে রাখে। রূপময় প্রকৃতি, সারি সারি চা বাগান, উঁচুনিচু পাহাড়টিলা, আকাশ-পাহাড়ের মিতালী, মেঘেদের ভেসে বেড়ানো, হাওর-বিলে পাখির কলতান, জলপ্রপাতের ছলছল ধ্বনি আর জীববৈচিত্র্যের সমাহারে এক মায়াবী সৌন্দর্যের খনি। আদিবাসি খাসিয়া, মণিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস এ চা কন্যার দেশে। তাদের লাস্যময় নৃত্য আর সাংস্কৃতিক ধারা, বিয়ে, পূজাপার্বন প্রকৃতিকন্যাকে করে তুলেছে মোহনীয় রূপে। খাসিয়া পানজুম, মণিপুরী কৃষি একে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এ জেলায় চা কন্যা হাঁটে প্রকৃতিকন্যার হাত ধরে। আবার প্রকৃতিকন্যা পথ চলে চা কন্যার ছায়া মাড়িয়ে। সবুজে ঘেরা পুরো জেলাই যেন পর্যটন স্পট।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান : দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাঝে সবচেয়ে দর্শনীয়, নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। পশুপাখি, বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাসস্থল। এ উদ্যানে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় জীব উল্লুকসহ কয়েকটি জন্তু ও বিলুপ্ত প্রায় কয়েকটি মূল্যবান গাছগাছালির শেষ নিরাপদ আবাসস্থল হলো লাউয়াছড়া। এ উদ্যান ভ্রমণপিপাসুদের একটি আকর্ষণীয় স্থান। ১৯২৫ সালে ১২৫০ হেক্টর জায়গাজুড়ে তৈরি লাউয়াছড়া উদ্যানকে ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় জাতীয় উদ্যান হিসেবে। এ জাতীয় উদ্যানে রয়েছে ৪৬০ প্রজাতির প্রাণিবৈচিত্র্য। এর ভেতর ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরিসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির অর্কিড, ২০ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। আগর বাগান, বিরল প্রজাতির গাছ, নানা প্রজাতির পাখির ডাক, ছড়া, বনফুল, অর্কিড, চশমাবানর, বিশ্বের বিলুপ্তপ্রায় দুর্লভ উল্লুক এ বনের বিশেষ আকর্ষণ। এ বনের বিচিত্র পশুপাখি ও পোকামাকড়ের অদ্ভুত ঝিঝি শব্দ, বানরের ভেংচি, ভালুকের গাছে গাছে ছোটাছুটির দৃশ্য দেখতে খুবই ভালো লাগে।
চা বাগান : চায়ের জন্য বিখ্যাত মৌলভীবাজার জেলা। পাতা আর কুঁড়ির এ দেশ পাহাড় আর চা বাগানে ঘেরা। আর সবসময় ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক আদর্শ স্থান। সবুজে মোড়ানো এ জেলায় রয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ চা বাগান। রয়েছে আনারস ও রাবার বাগান। চায়ের রাজধানীখ্যাত এ জেলায় শ্রীমঙ্গলের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পশুপাখির বিচরণ নিমিষেই মুগ্ধ করে দেয় চোখ আর মন। শ্রীমঙ্গলের উত্তর-পশ্চিমপাশে কিছু অংশ হাইল হাওর ছাড়া পুরোটা উপজেলা চা বাগানে ঘেরা। মাইলের পর মাইল চা বাগানের ভেতর দিয়ে গেলে মনে হয়, বিশ্বের সকল সৌন্দর্য যেন সামনে।
মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত : দেশের বৃহত্তম জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড। এ জেলার বড়লেখা উপজেলার কাঁঠালতলী বাজার থেকে ৪ কিলোমিটিার পূর্বে এগোলে কানে আসে ক্রমাগত জল গড়ানোর শব্দ। সেই সঙ্গে আছে সবুজ চা পাতার তাজা গন্ধ। প্রায় ২০০ ফুট পাথারিয়া পাহাড়ের ওপর থেকে ছোট-বড় পাথরের বুক চিরে আচড়ে পড়া জলরাশির ঝরনাধারার দৃশ্যে মন নাচে আনন্দ-আবেগে।
পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে দেশ-বিদেশে পরিচিত এ স্থানটিতে বর্তমানে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের রেস্ট হাউজ ও রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে বেড়েছে পর্যটন সম্ভাবনা। এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে পুরো এলাকা ঘিরে তৈরি করা হচ্ছে ‘মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক’। শ্যামল সবুজ বনরাজি বেষ্টিত মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, নয়নাভিরাম দৃশ্য, নান্দনিক পিকনিক স্পট, সুবিশাল পর্বতগীরি, পাহাড়ি ঝরনার প্রবাহিত জলরাশির কল কল শব্দ- সব মিলিয়ে মাধবকুণ্ড বেড়াতে গেলে পাওয়া যায় আনন্দের বাড়তি মাত্রা। প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমান এ ঝরনাধারার সৌন্দর্য উপভোগে। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে এলে চোখে পড়ে উঁচুনিচু পাহাড়ি টিলায় দিগন্তজোড়া চা বাগান। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়াদের পানপুঞ্জি ও জুম চাষ। পাহাড়িদের সনাতনী বাড়িঘর আর জীবনযাত্রার দৃশ্য সত্যিই অপূর্ব।
পরীকুণ্ড ঝরনা : সচরাচর লক্ষ করা যায়, দর্শনার্থীরা কেবল মাধবকুণ্ড ঝরনা দেখেই ফিরে আসেন। তাদের বেশির ভাগেরই জানা নেই, মাধবকুণ্ডের কাছেই রয়েছে পরীকুণ্ড নামে দৃষ্টিনন্দন আরও একটি ঝরনা। মাধবকুণ্ড যেতে পায়ে হাঁটা পথের মাঝামাঝি গিয়ে ডানদিকে নেমে গেছে আরেকটি পথ। পথটি ধরে নামলেই ছরা, তারপর ছরা ধরে হাঁটতে হয় বিশ থেকে পঁচিশ মিনিটের মতো। সামনেই ঝরছে পরীকুণ্ডের অনর্গল ধারা। মাধবকুণ্ড ও পরীকুণ্ড যাওয়ার পথে দু’পাশে উঁচুনিচু পাহাড় ও টিলাগুলো চা গাছে আবৃত।
হাকালুকি হাওর : এ জেলায় রয়েছে এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ জলাভূমি হাকালুকি হাওর। ২৪০টি বিল নিয়ে এ হাওরের আয়তন ২০ হাজার ৪০০ হেক্টর। হাওরটির অবস্থান জেলার বড়লেখা, জুড়ী, কুলাউড়া, সিলেটের বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলায় বিস্তৃত। হাওরের বেশিরভাগ এলাকা বড়লেখা উপজেলায় অবস্থিত।
নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ, পাখি, শাপলা-শালুক, ঝিনুক, শ’ শ’ প্রজাতির জলজ প্রাণী আর হিজল, কড়চ, আড়ং, মূর্তা, কলুমসহ সবুজেঘেরা এক পরিবেশ। শীতকালে হাওরের দিগন্ত বিস্তৃত প্রাকৃতিক দৃশ্য ও বিলের কান্দিগুলো সত্যিই দৃষ্টিনন্দন। বিলের জলের মাঝে ও চারপাশে জেগে থাকা সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়া কিঞ্চিত উঁচুভূমি বিলের জলে প্রতিচ্ছবি ফেলে সৃষ্টি করে অপরূপ দৃশ্য।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তেরর সময় হাওরের জলরাশির মাঝে সূর্যের প্রতিচ্ছবি বেশ মনোমুগ্ধকর। শীতকালে অতিথি পাখিরা সারি বেঁধে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসতে থাকে বিলগুলোতে। এসব পরিযায়ী পাখির আগমনে হাওর যেন পরিণত হয় স্বর্গোদ্যানে। বিমোহিত রূপ-মাধুর্যে কাছে টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের। এ সময় অতিথি পাখিদের সঙ্গে মিতালি গড়তে মানুষের কলকাকলিও বাড়ে হাওরপারে।