পরিবেশ বলতে আমরা আমাদের চারপাশের অবস্থাকে বুঝি। যেমন- গাছপালা, বাড়ি-ঘর, মাটি, পানি, বায়ু, জীবজন্তু, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, আকাশ-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, যানবাহন ও কলকারখানা ইত্যাদি। এগুলো সবই মহান আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। কোরআনের বিভিন্ন স্থানে বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির কিছু দৃশ্য মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। যেন মানুষ প্রাকৃতিক বিচিত্র, প্রকারভেদ, বর্ণ, গন্ধ ও সৌন্দর্য দেখে পুলকিত ও অভিভূত হয়; সবকিছুর উন্নতি, অগ্রগতি ও সক্রিয়তা দেখে মানুষ আল্লাহর শক্তিমত্তার কথা স্মরণ করে। তিনি বনভূমির মাধ্যমে পৃথিবীকে সুশোভিত ও অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেন। গাছপালার মাধ্যমে ভূমণ্ডল ও পরিবেশ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য সংরক্ষণের শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি তোমাদের জন্য পানি দ্বারা শস্য, জাইতুন, খেজুর গাছ, আঙুর ও সবধরনের ফল জন্মান। অবশ্যই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।’ (সুরা নাহল : ১১)।
পরিবেশ আল্লাহর বড় অনুগ্রহ : পরিবেশ বান্দার প্রতি আল্লাহর বড় অনুগ্রহ। পরিবেশ বিনষ্ট হলে মানুষ, প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হবে। মানুষের দায়িত্ব হচ্ছে, সে যে পরিবেশে বাস করে, তা সংরক্ষণ করা এবং বিপণ্ণ না করা। ইসলাম পরিবেশ রক্ষার উপকরণগুলো গ্রহণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তন্মধ্যে বৃক্ষরোপণ ও পানি ব্যবহারে অপচয় না করার ব্যাপারটি উল্লেখযোগ্য। বৃক্ষরোপণের প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কেয়ামত সংঘটিত হয়, আর সে অবস্থায় তোমাদের কারও হাতে একটি চারা (ছোট খেজুর বৃক্ষ) থাকে; যদি সম্ভব হয়, সে তা রোপণ করা পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, তাহলে সে যেন এটি রোপণ করে।’ (মুসনাদে আহমদ : ১২৯০২)।
মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ ও সমাজের সৃষ্টি : সৃষ্টির সেরা মানুষ মূলত সামাজিক জীব। মানুষকে ঘিরেই পরিবেশ ও সমাজের সৃষ্টি। আর পরিবার, পরিবেশ ও সমাজ নিয়ে ইসলামের পরিবেশগত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের জন্য নিদর্শন একটি মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি। তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য। তারা তা খায়। আমি তাতে উৎপন্ন করি খেজুর। প্রবাহিত করি ঝর্ণাধারা। যেন তারা তার ফল খায়।’ (সুরা ইয়াসিন : ৩৩)।
পরিবেশ সংরক্ষণে জীবন রক্ষা পায় : মানবজীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের জীবন রক্ষার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর নির্ভর করে। পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে ইসলাম দিকনির্দেশক। উন্মুক্ত স্থানে ময়লা-আবর্জনা, থুথু ও কফ ফেলা, মলমূত্র ত্যাগ করা পরিবেশ দূষণ করে। যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। নোংরা ও দূষিত পরিবেশ রোগ-ব্যাধির প্রধান কারণ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষা ও দূষণ প্রতিরোধে সবার যথোচিত দায়িত্ব পালন করা উচিত। সুস্থতা, সৌন্দর্য, মননশীলতা, উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির কথা বলে ইসলাম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের আঙিনাকে পরিচ্ছন্ন রাখো।’ (তিরমিজি : ২৭৯৯)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ।’ (মুসলিম : ২২৩)।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধে পাহাড়-পর্বত : সমগ্র সৃষ্টিজগতের কল্যাণের জন্য আল্লাহতায়ালা পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করেছেন। ভূমিকম্প বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যাতে মানুষকে নিয়ে পৃথিবী নড়াচড়া করতে না পারে, সেজন্য আল্লাহতায়ালা পাহাড়গুলোকে পেরেকের মতো গেড়ে দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনি পৃথিবীতে সুদৃঢ় পর্বত স্থাপন করেছেন। যেন পৃথিবী তোমাদের নিয়ে আন্দোলিত না হয়।’ (সুরা নাহল : ১৫)।
পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষ রোপণ : পরিবেশ সংরক্ষণের যে সকল উপায়ের প্রতি ইসলাম আহ্বান জানায়, বৃক্ষরোপণ করা তার অন্যতম। আর বন জ্বালিয়ে ফেলা সবচেয়ে ভুল কাজ। বৃক্ষরোপণে উৎসাহ দিয়ে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে বা কোনো শস্য উৎপাদন করে এবং তা থেকে কোনো মানুষ কিংবা পাখি অথবা পশু খায়, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা হবে।’ (বোখারি : ২৩২০, মুসলিম : ১৫৬৩)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বৃক্ষ রোপণ করে তা ফলদার হওয়া পর্যন্ত তার পরিচর্যা ও সংরক্ষণে ধৈর্য ধারণ করে, তার প্রতিটি ফল যা নষ্ট হয়, তার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা তাকে সদকার নেকি দেবেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৬৭০২)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো বৃক্ষ রোপণ করে, আল্লাহতায়ালা এর বিনিময়ে তাকে ওই বৃক্ষের ফলের সমপরিমাণ প্রতিদান দান করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৫৬৭)।
বৃহৎ কল্যাণে গাছপালার প্রয়োজনীয়তা : আল্লাহতায়ালা মানুষকে প্রকৃতির যতগুলো নেয়ামত দান করেছেন, বৃক্ষরাজি তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকা ও বৃহৎ কল্যাণের জন্য গাছপালা, বৃক্ষলতা ও মৌসুমি ফল-ফসলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মহান আল্লাহর সৃষ্টি বৃক্ষরাজি যে কত বড় নেয়ামত, তা পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াত থেকে বোঝা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কী লক্ষ্য করে না, আমি অনুর্বর ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে শস্য উদ্গত করি। যা থেকে তাদের গবাদিপশু ও তারা আহার গ্রহণ করে।’ (সুরা সাজদা : ২৭)।
পানির অপর নাম জীবন : পৃথিবীতে বসবাসের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তু হলো পানি। আল্লাহতায়ালা পানি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের ৬০ স্থানে আলোচনা করেছেন। পানি ছাড়া আমাদের জীবন অচল। তাই পানির অপর নাম জীবন। পানি হচ্ছে প্রাণ সৃষ্টির মূল উপাদান। রাসুল (সা.) পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। পানির ঘাট, রাস্তার মাঝে এবং বৃক্ষের ছায়াতলে মলত্যাগ থেকে বারণ করেছেন। পানি স্বল্পতার ফলে কৃষি হ্রাস পায়। আবার কখনও তা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়। পানির গুরুত্বের কারণে ইসলাম সব ক্ষেত্রে পানি অপচয় করতে নিষেধ করে; এমনকি ইবাদতসমূহের ক্ষেত্রেও। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রাণবান সবকিছু পানি হতে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ৩০)।
পরিবেশ দূষণ মানবদেহের জন্য হুমকিস্বরূপ : বৃহদাকারে শিল্পবিপ্লবের নিদর্শন রোজ প্রত্যক্ষ ও অনুভব করছি। এর সঙ্গে পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশের উৎস নিঃশেষ করে ফেলার সমস্যা দেখা দিয়েছে। খাদ্য ও বায়ুদূষণের কারণে মানবদেহে এবং তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রতিটি অঙ্গে দূষণ পৌঁছে যাচ্ছে। যুদ্ধবিগ্রহ পরিবেশের সঙ্গে গুরুতর ক্ষয়-ক্ষতি যুক্ত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের কারণে ব্যাপক প্রভাব দেখা গেছে। এ কাজটি মানুষের মাঝে এবং পরিবেশে সবচেয়ে মন্দ প্রভাব ফেলে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের কৃতকর্মের কারণে স্থলে ও জলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। (সুরা রুম : ৪১)। আমাদের জীবন রক্ষার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর নির্ভর করে। পরিবেশ সংরক্ষণের মাঝে জীবনের সুরক্ষা নিহিত। সুতরাং আমাদের উচিত, পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। কেননা, এটিও একধরনের ইবাদত।