ঢাকা ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হেমন্তে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
হেমন্তে বাংলার প্রকৃতি ও পরিবেশ

মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির জমতে শুরু করেছে ঘাসের ডগায়, ধানের শিষের ওপর। আদিগন্ত মাঠজুড়ে এখন ধানের প্রাচুর্য। হলুদে-সবুজে একাকার অপরূপ প্রকৃতি। চারিদিকে ধূসর আবহ ঘিরে রাখছে। শেষ বিকেলে কুয়াশার আবছা চাদর প্রকৃতিকে ঢেকে শিশিরের শব্দের মতো নামছে সন্ধ্যা। কবি বলেন, ‘হেমন্ত তার শিশিরভেজা/আঁচল তলে শিউলি বোঁটায়, চুপে চুপে রং মাখাল/ আকাশ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায়/...।’ সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে/কোন পাথারের ওপার থেকে/ আনল ডেকে হেমন্তকে। কার্তিকের মাঝামাঝি অবস্থান করছি আমরা। আবহমান বাংলায় ষড় ঋতুর পরিক্রমায় এলো হেমন্ত। শরৎকালের পর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মিলে হেমন্ত। নতুন ঋতুর আগমনে রূপ বদলায় প্রকৃতি। হেমন্তকে বলা হয় শীতের বাহন। প্রকৃতিতে অনুভূত হচ্ছে শীতার্ত আমেজ। দিনে তাতানো রোদ্দুর থাকলেও শেষ রাতে কুয়াশা ঘিরে রাখছে জনপদ।

হিম হিম গ্রামীণ জনপদ : গ্রামীণ জনপদে এখন হিম হিম অনুভব। খণ্ড খণ্ড মেঘ সরে গিয়ে উদোম হয়েছে বিশাল নীলাকাশ। আনন্দধারায় ভাসছে কৃষকের মন-প্রাণ। কারণ, এ হেমন্তে বাড়ির উঠোন ভরে উঠবে নতুন ধানের মণ্ডম গন্ধে। বাঙালির প্রধান অন্ন, আমন ধান কাটার মাহেন্দ্র সময় হেমন্তের শেষ ভাগে। আশ্চর্য ঋতু হেমন্তে প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনা আর স্তুতিতে মগ্ন হয়েছেন কবি-সাহিত্যিকরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা/ হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূসর রঙে আঁকা।/সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে, /কণ্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা। / ধরার আঁচল ভরে দিলে প্রচুর সোনার ধানে। / দিগঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে...।

কার্তিকের দুর্নাম ‘মরা কার্তিক’ : কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘অবসরের গান’ কবিতায় হেমন্তের অপরূপ চিত্র এঁকেছেন, ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের ওপর মাথা রেখে/ অলস গেঁয়োর মতো এইখানে-কার্তিকের ক্ষেতে;/ মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার/ চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ/ তার আস্বাদ পেয়ে পেকে ওঠে ধান...। হেমন্ত জীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য সময় হয়ে ওঠে। বর্ষার পরে এ সময়ে বৃক্ষরাজি থাকে সবুজে ভরা।

ভরা থাকে খালবিল নদীনালা। বিলজুড়ে সাদা-লাল শাপলা আর পদ্ম ফুলের সমারোহ। এ হেমন্তের দুই রূপ প্রতিভাত হয়। প্রথম মাসটির এক রূপ, পরেরটির অন্য। একসময় হেমন্তের প্রথম মাস ছিল অনটনের। ফসল হতো না। বিভিন্ন অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দিত। সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখা চাল ফুরিয়ে যেত এ সময়ে। ধানের গোলা শূন্য হয়ে যেত। কার্তিকের দুর্নাম করে তাই বলা হতো ‘মরা কার্তিক’। কবিগুরুর কবিতায়ও আভাস পাওয়া যায় মন্দাক্রান্ত কার্তিকের। তিনি লিখেছেন, ‘শূন্য এখন ফুলের বাগান, দোয়েল কোকিল গাহে না গান, /কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে।’

হেমন্তের বাতাসে পাকা ধানের ঘ্রাণ : অগ্রহায়ণে আবার উল্টো চিত্র। নবান্নের মাস সমৃদ্ধির। এ সময় মাঠের সোনালি ফসল কাটা শুরু হয়। দেখতে দেখতে গোলা ভরে ওঠে কৃষকের। হেমন্তের বাতাসে ভেসে বেড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। বাড়ির আঙিনা নতুন ধানে ভরে ওঠে। কৃষকবধূ ধান শুকাতে ব্যস্ত থাকে। প্রতি ঘর থেকে আসে ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ। অবশ্য এখন দিনে দিনে বদলাচ্ছে সেই হিসাব-নিকাশ।

এখন আগের সেই অভাব নেই। শস্যের বহুমুখীকরণের ফলে মোটামুটি সারা বছরই ব্যস্ত কৃষক। বিভিন্ন ফসল ফলান তারা। আয়-রোজগারও বেশ। পাশাপাশি এখন কার্তিক মাসেই হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে আগাম আমন ধানের শীষ। পাকা ধান কাটা শুরু হয়ে যায়। অগ্রহায়ণের পুরোটা জুড়ে সারা বাংলায় চলে নবান্ন উৎসব। বাঙালির প্রধান ও প্রাচীনতম উৎসবগুলোর একটি নবান্ন। কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পুরোভাগে থাকা এ নবান্ন অনাদিকাল থেকে বাঙালির জীবন অধিকার করে আছে।

প্রথম রোদের বর্ণচ্ছটায় পাতাগুলো হেসে ওঠে : ঋতুচক্রের পরিক্রমায় বঙ্গঋতুনাট্যে শরতের পরে শূন্যতা, রিক্ততা ও বিষণ্ণ প্রকৃতির মেদুরতাহীনতায় আবির্ভূত হয় হেমন্তঋতু। শরৎ প্রকৃতির বহু বর্ণিল ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতার আবেশ মানবমনে শিহরণ তোলে না। শিহরণ তোলে হিমসমীরণে অদূরবর্তী তুষরের আগমনীবার্তা।

হেমন্ত ঋতুর প্রারম্ভে ব্যাপ্তচরাচরে বিস্তীর্ণ নয়ন বৈরাগ্যের বিষণ্ণতা, হতাশা ও রিক্ততার অশুভ ধ্বনি দেখে। কিন্তু পক্ষকাল শেষে হেমন্তের শুভাশিসে রাশি রাশি ভারা ভারা কনক আভাময় পাকা ধান মাঠে মাঠে শোভা পেতে থাকে। রৌদ্রখর তপ্তদাহ উপেক্ষা করে যে কৃষক ফলিয়েছে সোনা ধান ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে, তার অন্তঃস্থল থেকে বেরিয়ে আসে প্রাপ্তির নির্মল হাসি। প্রকৃতির এই যে কল্যাণময়ী রূপশ্রী, অকাতরে অন্নের সংস্থান বঙ্গবাসীকে প্রাচুর্যময়ী হেমন্তের অকৃপণ ভালোবাসারই নামান্তর। বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে, / বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে, / দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা, / দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু। / দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, / ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, / একটি ধানের শিষের উপরে/ একটি শিশিরবিন্দু। রবি ঠাকুরের সে আহ্বানেই মায়াময় স্নিগ্ধরূপ নিয়ে এসেছে হেমন্তের সকাল। সকালের প্রথম রোদের বর্ণচ্ছটায় গাছের পাতাগুলো খিলখিল করে হেসে ওঠে। তখনই হালকা শীতের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।

হেমন্তের প্রতিটি সকাল শ্রেষ্ঠ : দৃষ্টিসীমা যতদূর পৌঁছে, আলোকোজ্জ্বল অপূর্ব একটি সকাল তার অভাবনীয় সৌন্দর্য নিয়ে যেন অপেক্ষমান। গাছেদের নরমণ্ডকচি পাতাগুলোর ফাঁকে ফাঁকে মিষ্টি রোদ আর সুনীল আকাশ যেন হাতছানি দিয়ে ডাকে। প্রকৃতির মাঝে এভাবে সৌন্দর্য ফুটে ওঠার ছবি দৃশ্যমান হয়ে থাকে বলেই দৃশ্যময়তার বিবেচনায় হেমন্তের প্রতিটি সকাল শ্রেষ্ঠ। ধানের শীষে, ঘাসের বুকে, পাতার শরীরে শিশির জমে থাকার গভীর সৌন্দর্যের পটভূমি তুলে ধরে বলেই প্রতিটি হেমন্তের সকালের রয়েছে নিজস্বতা। প্রকৃতি এমন একটি অভাবনীয় রৌদ্রোজ্জ্বল হেমন্তের সকালের রূপ আমাদের সামনে তুলে ধরে যেন সফলতার চিত্র উপহার দেয়। জীবন যাপনের যন্ত্রণাকাতর দীর্ঘ পটভূমি পেরিয়ে এমনই একটি আলোকময় চির সুন্দর সকালের অনুপ্রেরণা কাম্য। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে সত্য ও সুন্দরের অনুভূতি নিয়ে কর্তব্য-কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ার সংকল্প যেন প্রকাশ করে হেমন্তের সকাল। প্রকৃতির অপূর্ব দৃশ্যাবলির সমন্বয়ে গাঁথা হেমন্তের প্রতিটি সকালের রূপ।

কখনো ঝড়-মেঘ, কখনো কুয়াশা : হেমন্ত আসে, হেমন্ত যায়। হেমন্ত মানেই আমরা এখন অনেকেই ভাবি, নবান্নের ঋতু। কিন্তু হেমন্ত যে এক বহুরূপী প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ এক ঋতু, সে কথা ভুলে যাই। খানিকটা ঠান্ডা, খানিকটা গরম, অনেকটাই নাতিশীতোষ্ণ- এ রকম এক আবহাওয়ার ঋতু হেমন্ত। কখনও ঝড়-মেঘ, কখনও কুয়াশা। সবুজ ধানক্ষেতগুলো ধীরে ধীরে সোনা রঙে বদলে যাওয়া। অতিথি পাখিদের আগমন শুরু। গাঁয়ে গাঁয়ে খেজুর গুড় আর পিঠার ঘ্রাণ। ঝকমকে তাজা মাছে সাজানো জেলেদের ডালা। এই তো আমাদের অনেক রূপের হেমন্তের প্রকৃতি। আর সে প্রকৃতির আশ্রয়ে আমরা একটু অন্যরকম হই হেমন্তের মানুষগুলো। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘হিমের রাতে’ কবিতায় হেমন্তের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে লিখেছেন, ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে, / হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে। / ঘরে ঘরে ডাক পাঠাল/ দীপালিকায় জ্বালাও আলো, / জ্বালাও আলো, / আপন আলো, / সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।

অভিলাষী হেমন্তে বিরহী কামনা : শরতের শুভ্রতা শেষে হেমন্ত বাংলার জীবনকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে। আশ্বিন-কার্তিক দুই মাস হেমন্তকাল। স্থায়িত্ব মাত্র দুই মাস; কিন্তু এর প্রভাব অসীম। হেমন্তের স্নিগ্ধ, মায়াময় প্রকৃতির মধ্যে মানুষ যেন তার জীবনকেই খুঁজে ফেরে। এই ঋতুতে মানুষের আসে প্রেম, ইচ্ছা। আকাঙ্ক্ষা ও অভিলাষ এক ভিন্নমাত্রা পায়। হেমন্ত বাংলার মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে ভাব, প্রকৃতিপ্রেম, বাঙালিয়ানা আর নিরন্তর সৃজনশীল কর্মকাণ্ড। কবি সুফিয়া কামাল ‘হেমন্ত’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সবুজ পাতার খামের ভেতর/ হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে/ কোন পাথারের ওপার থেকে আনল ডেকে হেমন্তকে?’ হেমন্তের অপার সৌন্দর্য মানুষের মনকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলে। এই সৌন্দর্য প্রেমিক হৃদয়কে মাতোয়ারা করে দিয়ে তার মনোলোকে তৈরি করে আশ্চর্য এক জগৎ। যেখানে জীবন ও মানুষ হয়ে ওঠে মূল শক্তি। আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি প্রকৃতির গভীর সান্নিধ্য থেকে। উপলব্ধির চেতনায় এখন আর ধরা পড়ে না প্রকৃতির সুনিবিড় দৃশ্যপটগুলোর তাৎপর্য। ছয় ঋতু বাংলার প্রকৃতির বুকে যে গভীর সৌন্দর্য-শোভা ছড়িয়ে রেখেছে, তাও যেন হৃদয় দিয়ে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। আবার ভয় হয়, যেভাবে পৃথিবীর জলবায়ু বদলাচ্ছে, তাতে আগামীতে এই আপন হেমন্তকে খুঁজে পাব তো!

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী, কবি ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত