পাখপাখালির বাংলাদেশ

আবদুল্লাহ নোমান

প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মহান আল্লাহর বিচিত্র সৃষ্টির অন্যতম পাখপাখালি। আমরা দেখি বা না দেখি, তারা আমাদের অসংখ্য উপকার করে থাকে। পাখি শুধু পরিবেশের ভারসাম্যই রক্ষা করে না, উদ্ভিদের সার জোগান থেকে শুরু করে বনভূমির পোকা নিয়ন্ত্রণসহ অসংখ্য উপকার করে আমাদের পরম শুভার্থী বন্ধুর ন্যায়। বাতাসি পাখি শূন্যে উড়ে উড়ে বিচিত্র রকম ভঙ্গি করে উড়ন্ত পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ ধরে ধরে খায়। ওরা অল্পসময়ে অনেক পোকা ধরে খেয়ে ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ছোট পাখি ঘণ্টায় প্রায় ১২শ পোকা ধরে খেতে পারে।

কাঠঠোকরারাও পোকাখেকো পাখি গাছের ডাল এবং গুঁড়ি থেকে পোকা খুঁটে খুঁটে খায়। এভাবে অক্সিজেন সরবরাহকারী গাছ টিকিয়ে রাখতেও সহায়তা করে পাখি। আবার ঘরের আশপাশে থাকে যেসব বিষধর পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ, তাদের ধরে ধরে খায় চড়ুই এবং দোয়েলরা। কৃষক যখন জমিতে লাঙল দেয়, তখন গো-বক, ছোট সাদা বক, গো-শালিক, ফিঙে ইত্যাদি পাখি নানাবিধ পোকামাকড় খেয়ে হালের গরুকে পোকার জ্বালাতন থেকে রক্ষা করে। গরু এবং ছাগল মাঠে ঘাস খাওয়ার সময় জোঁকসহ নানাবিধ পোকা আক্রমণ করে। ফিঙে এবং শালিকের দল সে আক্রমণ থেকে রক্ষা করে গরু-ছাগলকে। গরু ও ছাগলের লোমের ভেতর এক ধরনের পোকা বাসা বাঁধে। পাখিরা সেসব পোকাও খুঁটে খুঁটে খেয়ে ডাক্তারের ভূমিকা পালন করে। তাই নিঃসন্দেহে পাখিরা আমাদের উপকারী বন্ধু। আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে তাদের শূন্যে ওড়ার সক্ষমতা আল্লাহর কুদরতের বিরাট নিদর্শন।

এরশাদ হয়েছে, ‘তুমি কি জানো না যে, আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীতে যারাই আছে, তারা আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করে এবং পাখিরাও, যারা পাখা বিস্তার করে রাখে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ ইবাদত ও তাসবিহ (এর পদ্ধতি) জেনে রেখেছে। তারা যা করে, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত।’ (সুরা নুর : ৪১)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে উসমানিতে উল্লেখ আছে, ‘আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক বস্তুকে তার অবস্থানুযায়ী ইবাদত-বন্দেগি ও তাসবিহ পড়ার যে পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন, সে অনুযায়ী তারা নিজেদের অজিফা আদায় করতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, মানুষরূপী বহু লোক অহংকার ও উদাসীনতায়, মূর্খতা ও অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আপন মালিকের স্মরণ ও দাসত্ব থেকে বিরত রয়েছে।’ (তাফসিরে উসমানি : ২৪৮)।

পাখপাখালি মানুষের হিতাকাঙ্ক্ষী : পক্ষীকুল আমাদের পরম বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষী। চিল, ঈগল, বাজ এবং অন্যান্য শিকারি পাখিকে নিয়ে মানুষ যদিও শঙ্কিত থাকে, হাঁস-মুরগির ছানা খেয়ে ফেলে বলে; কিন্তু তারা মেঠো ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর ইত্যাদি শিকার করে ফসলের ক্ষেতের দারুণ উপকারও করে। তা ছাড়া পাখির ডিমণ্ডবাচ্চা খেয়ে ফেলে এমন সাপ ও অন্যান্য প্রাণীকেও ওরা শিকার করতে ভুল করে না। ফণা-তোলা বিষধর সাপটি যদি নজরে পড়ে ঈগলের, তাহলে রক্ষা কি মেলে সেই সাপের? মশামাছি, কীটপতঙ্গ নানা স্থানে বিষাক্ত জীবাণু ছড়ালেও এসব পোকামাকড়ের হাত থেকে বিপণ্ণ মানুষকে রক্ষা করে পাখিরা। ভুবনচিল, শঙ্খচিল আর কাকেরা শহর পরিচ্ছন্ন রাখে ময়লা খেয়ে। মরা জন্তু ও অন্যান্য ময়লা খেয়ে গ্রামাঞ্চলের পথঘাট আর মাঠ পরিষ্কার রাখে শকুনরা। দেশে দুর্ভিক্ষ বা বন্যা হলে শকুনেরা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে নিচে। চারপাশে ছড়ানো মরা জন্তুদের খেয়ে ফেলে অল্পসময়ের মধ্যে। খাদ্য সংগ্রহে নানা রংয়ের ফল-ফুলে ভরা গাছপালায় পাখিদের উপচেপড়া ভিড় ও কিচিরমিচির গুঞ্জন দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। ওদের এই খাদ্য সংগ্রহ গাছের এবং মানুষের জন্য দারুণ উপকারী। পাখিরা পাকা ফল খাওয়ার সময় বীজটিও খেয়ে ফেলে। পরে সেই বীজ তার পায়ুপথ দিয়ে পায়খানা হয়ে বেরিয়ে যায়। এতে একটি গাছের বীজ নানা স্থানে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এ বীজগুলো যদি পাখিরা না খেত, তাহলে সব বীজ পড়ত বড় গাছের নিচে। জন্মাত হাজার হাজার গাছ। এসব গাছ পর্যাপ্ত আলো বাতাস না পেয়ে শুকিয়ে মরে যেত। বীজগুলো বিস্তীর্ণ জায়গায় ছড়িয়ে দিতে এবং গাছকে ভালোভাবে বড় করে তুলতে পাখিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। হাঁস ও অন্যান্য পাখি জলাশয়ে যে মল ত্যাগ করে, তা নাইট্রোজেন সার।

মজার বিষয় হচ্ছে, অনেক ছোট ছোট বীজ পাখিদের কাদামাখা পায়ে অথবা পালকে আটকে যায়। এভাবে দূর দেশে পাখির সঙ্গে চলে যায় গাছের বীজ। আমাদের দেশে এমন অনেক বিদেশি গাছ আছে, যা অতিথি পাখিরা নিয়ে এসেছিল বীজ অবস্থায়। আমাদের দেশের অনেক গাছের বীজ ওরা নিয়ে গেছে বিদেশে। ফুলের পরাগ সংমিশ্রণেও পাখিরা সবচেয়ে সক্রিয়। নানান রকম মৌটুসি, টুনটুনি, ফুলঝুরি ইত্যাদি পাখি ফুলের ভেতর থেকে মধু বের করে খায়। মধু খাওয়ার সময় ফুলের কিছু রেণু ওদের মাথায় কিংবা পালকে কিংবা ঠোঁটের চারপাশে আটকে যায়। শরীরে রেণুমাখা পাখিটি যখন অন্য ফুলে গিয়ে বসে, তখন তার বয়ে আনা রেণু অন্য ফুলের রেণুর সঙ্গে মিশে ফল ফলানোর কাজে লাগে।

পাখিরা আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যস্থলে শূন্যলোকে কখনও ডানা মেলে, কখনও ডানা গুঁটিয়ে উড়তে থাকে অবিরাম। ওদের ভারী দেহের আকর্ষণ সত্ত্বেও পড়ে যায় না নিচে। বায়ুর মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভেসে বেড়াতে পারে স্বচ্ছন্দে, নিশ্চিন্তে। রহমানেরই অনন্য কুদরত এ মহাবিস্ময়। তিনি এরশাদ করেছেন, ‘তারা কি তাদের ওপরে পাখিদের দেখে না, যারা কখনও ডানা মেলে রাখে এবং কখনও গুটিয়ে রাখে। দয়াময় (আল্লাহ) ছাড়া আর কেউ তাদের ধরে রাখে না। নিশ্চয় তিনি সবকিছুর সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা মুলক : ১৯)।

মৌমাছি রবের কুদরতের নিদর্শন : মৌমাছির নামে আল্লাহতায়ালা কোরআনে একটি সুরা নাজিল করেছেন (সুরা নাহল)। এটি একটি ক্ষুদ্রকায় প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও নিজ বাসস্থান (মৌচাক) তৈরি করে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারিগরি ও শিল্পনিপুণতার সঙ্গে। সব মৌমাছি তাদের দলীয় প্রধান রানিমৌমাছির অধীনে দলবদ্ধ থেকে কাজ করে পূর্ণ আনুগত্যের সঙ্গে। মৌমাছি হরেক রকম ফলমূল থেকে খাদ্য আহরণ করে আমাদের জন্য মধু তৈরি করে রবের নির্দেশে। যা একদিকে যেমন বলকারক ও সুস্বাদু, তেমনি নিরাময়ের উপকরণও। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মধু অনেক রোগের প্রতিকারে ভূমিকা পালন করে। দেহে তৈরি করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। বৃদ্ধি করে দৃষ্টিশক্তি ও স্মরণশক্তি। দেহের বিভিন্ন ধরনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে মধু বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সর্দি-কাশি ও মরণঘাতী ক্যান্সার রোধেও মধুর বড় ভূমিকা আছে। পিত্ত থলির সংক্রমণ রোধ করতে, বাতের ব্যথায়, মুখের দুর্গন্ধ কাটাতে, এমনকি শরীরের বাড়তি ওজন কমাতেও মধু খুবই কার্যকরী উপাদান।

এ ছাড়া এনজাইম, বিভিন্ন খনিজ যেমন- পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ ও প্রোটিন আছে এতে। তাই এটি মহৌষধও বটে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আপনার রব মৌমাছিকে আদেশ করেছেন, তুমি ঘর তৈরি কর পাহাড়-পর্বতে, গাছে এবং মানুষ যে মাচান তৈরি করে, তাতে। অতঃপর সব রকমের ফল থেকে খাও, তারপর চল আপন রবের উন্মুক্ত-বাধাহীন পথসমূহে। তার পেট থেকে নির্গত হয় নানা রঙের পানীয়, যাতে আছে মানুষের জন্য রোগমুক্তি। নিশ্চয় এতে নিদর্শন রয়েছে সেই লোকদের জন্য, যারা চিন্তাভাবনা করে।’ (সুরা নাহল : ৬৮-৬৯)।

লেখক : সিনিয়র মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম