বাতাসে কমে গেছে আর্দ্রতা। প্রকৃতিতে এখন শীতের আমেজ। সন্ধ্যা-সকাল কুয়াশার চাদর মুড়ে দিচ্ছে চারপাশ। ঘাসের ডগায় দেখা মিলছে শিশিরের ‘মুক্তোর দানা’। হেমন্তের পর প্রকৃতিতে শীতল পরশ নিয়ে এলো পৌষ। শীতকে কেউ কেউ ‘নীরবতা ও অন্ধকারের অনুভূতি’ বলে প্রকাশ করেছেন। শীতের প্রচণ্ড দাপট কখনও কখনও ক্ষণিকের জন্য জীবনকে আড়ষ্ট করে তুললেও বাড়িয়ে দেয় মনের সজিবতা। অধিকাংশ মানুষেরই প্রিয় ঋতু শীত। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী বলেছেন, ‘পউষের প্রবল শীত সুখী যেজন।/তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ/ফুল্লরার কত আছে কর্মের বিপাক।/মাঘ মাসে কাননে তুলিতে নাহি শাক।’ পরবর্তীকালে আধুনিক কবিরাও শীতকালের বন্দনা কিংবা বর্ণনা করেছেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকির ওই ডালে ডালে।’ তিনি ‘শীতের প্রবেশ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘শীত, যদি তুমি মোরে দাও ডাক দাঁড়ায়ে দ্বারে।/সেই নিমেষেই যাব নির্বাক অজানার পারে।’ জসীম উদ্দীনের কবিতায় এসেছে ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে/ সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ : ষড়ঋতুর এমন দেশে প্রত্যেক ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়েই আবির্ভূত হয়। পৌষ ও মাঘ মাস শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ মাস থেকেই শীতের সূচনা শুরু হতে থাকে। এমন শীতের আগমন পত্রকুঞ্জে এবং জলে-স্থলে সর্বত্রই যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আসলেই হেমন্তের প্রৌঢ়ত্বের পরে আসে জড়তাগ্রস্ত শীত ঋতুর ‘নির্মম বার্ধক্য’। শুষ্ক-কাঠিন্য এবং রিক্ততার বিষাদময় প্রতিমূর্তিরূপেই শীতের আবির্ভাব ঘটে। তবুও এ শীতের শুভ্রতার প্রকৃতি অনেকেরই ভালো লাগে, মন ছুঁয়ে যায়। বাংলাদেশের ঋতুচক্রে অন্য পাঁচটি ঋতু থেকে শীতকালের বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। শীতের অবস্থান হেমন্তের পরে এবং বসন্তের আগে। মূলত শীত শুষ্ক চেহারা আর হিমশীতল অনুভব নিয়ে আসে। এ সময় গ্রামবাংলা যেন শীতের চাদর মুড়ি দেয়। ভোরবেলা ঘন কুয়াশার ধবল চাদরে ঢাকা থাকে। হিমেল হাওয়ায় হাড় কাঁপিয়ে শীত জেঁকে বসে। শীতের দাপটে প্রকৃতি নীরব হয়ে যায়। সবুজ প্রকৃতি রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। শীতের শুষ্কতায় অধিকাংশ গাছপালার পাতা ঝরে পড়তে থাকে। শীত তার চরম শুষ্কতার রূপ নিয়ে প্রকৃতির ওপর জেঁকে বসে। রুক্ষতা, তিক্ততা ও বিষাদের প্রতিমূর্তি হয়ে শীত আসে। শীতের তাণ্ডবে প্রকৃতি বিবর্ণ হয়ে পড়ে।
শীতে শীতে যায় বেলা : শীতের সকাল কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশায় ঢাকা। সবকিছু জড়োসড়ো হয়ে আসে। সামনের কোনো কিছু ঠিকমতো দেখা যায় না। সবকিছুই অস্পষ্ট মনে হয়। কখনো কখনো কুয়াশার স্তর এত ঘন থাকে, দেখলে মনে হয়, সামনে কুয়াশার পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দেরিতে ওঠে সূর্য। প্রকৃতির উপর সূর্যের নির্মল আলো ছড়িয়ে পড়ে। দেখে মনে হয়, সূর্যের আলোতে কোনো তেজ নেই। গভীর রাত থেকে গাছের পাতায় শিশির বিন্দু জমতে থাকে। আর ভোররাতে শিশিরকণা বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে। টিনের চালে, ঘরের চালে, পাতার ওপর টুপটাপ বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। সকালে মাঠে মাঠে ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু জমে থাকা শিশির রোদের আলোয় ঝিকমিক করে। ধানখেত-শাকসবজির ওপর টলমল করা শিশির বিন্দু সূর্যের সোনালি রশ্মিতে মুক্তার মতো ঝলমল করে। এ সময় গ্রামের খেতে খেতে ধান কাটা শুরু হয়। বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। শীতে এ সময় শহর-গ্রামের সবখানে চলে নবান্ন উৎসব।
খেত রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত : শীতকালে পাকা ধানের সোনালি খেতের দৃশ্য দেখে চোখ ফেরানো যায় না। পাকা ধান কেটে ঘরে তোলার পরপরই কৃষকরা আবার বোরো আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে কৃষক লাঙল-জোয়াল কাঁধে গরু নিয়ে মাঠে চলে। যদিও এ দৃশ্য আজকাল খুব একটা চোখে পড়ে না, তবু কিছু কিছু এলাকায় গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ হচ্ছে। সারাদিনই কৃষকরা চাষাবাদে ব্যস্ত সময় পার করে। তারা বোরো বীজতলা, সদ্য রোপা বোরো আবাদ রক্ষা করতে সকাল-বিকেল পানি পরিবর্তন করে শীতের হাত থেকে খেত রক্ষা করতে পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে।
সাজপোশাকে আসে বৈচিত্র্য : গ্রাম্য এলাকার শীতের সকাল ও বিকাল বড়ই চমৎকার। শীতের দীর্ঘ রজনী কম্বল-লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে রাত কাটে। সকালে সূর্য ওঠার অপেক্ষায় সবাই উশখুশ করতে থাকে। চায়ের দোকানগুলোতে চা পানের ধুম পড়ে। সকালের মিষ্টি রোদে ছেলেমেয়েরা চিড়া, মুড়ি, খেজুরের পাটালি গুড় খেতে খেতে রোদ পোহাতে থাকে। শীতের দিনে বেলা ছোট হওয়ায় বেলা মাথার ওপর আসতে আসতে যেন সন্ধ্যা হয়ে যায়। এ সময় শীতের দাপট থেকে বাঁচতে সবাই জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার এবং কোটসহ রং-বেরঙের বাহারি শীতবস্ত্র পরিধান করে। সাজপোশাকে আসে বৈচিত্র্য। বাহারি এসব পোশাক দেখে চোখ জুড়ায়। শীতে প্রকৃতি যেন ঝিমিয়ে পড়ে। শীতের শুষ্কতায় প্রকৃতি বিবর্ণ-রুক্ষ মূর্তি ধারণ করে। হাড় কাঁপানো শীতের দাপটে অনেক অস্বস্তিকর অনুভূতির মধ্যে একটি হলো ঠোঁট ও পা ফেটে যাওয়া। শীত থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন প্রসাধনীর কদর বেড়ে যায়।
শীতের খেজুরের মিষ্টি রস মন কাড়ে : শীত ছাড়া অন্য সময় খেজুরের রস পাওয়া যায় না। শীতে খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে গাছ কাটে গাছিরা। হেমন্তের শুরুতেই খেজুরগাছ থেকে রস বের করার উপযোগী করে কাটা শুরু হয়। খেজুরগাছ কাটা ও তা থেকে রস বের করার মধ্যেও কিছু কৌশল আছে। যে কেউ ভালো করে গাছ কাটতে কিংবা রস বের করতে পারেন না। কখন, কীভাবে, কোনখানে কেমন করে কাটতে হবে এবং গাছ মারা যাবে না, অথচ বেশি রস পাওয়া যাবে, তা একজন দক্ষ গাছিই ভালো জানেন। শীত যত বাড়তে থাকে, খেজুর রসের মিষ্টতাও তত বাড়ে। শীতের সঙ্গে রয়েছে খেজুর রসের এক অপূর্ব যোগাযোগ। এ সময় গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ থেকে সুমধুর রস বের করে গ্রামের ঘরে ঘরে পুরোদমে শুরু হয় পিঠা, পায়েস ও গুড় পাটালি তৈরির ধুম। গ্রামে গ্রামে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি করা নলের গুড়, ঝোলা গুড়, দানা গুড় ও পাটালি গুড়ের মিষ্টি গন্ধেই যেন অর্ধভোজন হয়ে যায়। খেজুর রসের পায়েস, রসে ভেজা পিঠাসহ বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের তো জুড়ি নেই। কালের বিবর্তনে প্রকৃতি থেকে আজ খেজুরের রস একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
শীতে শাকসবজিতে খেত ভরে ওঠে : লালশাক, পালংশাক, শিম, বরবটি, লাউ, টমেটো, গাজর, শালগম এবং মুলাসহ নানা রকম সবজি শোভাবর্ধন করে। যা আমাদের খাবার হিসেবে আকৃষ্ট করে। সরিষাফুলের হলুদ খেত আর মৌমাছির গুঞ্জনের দৃশ্য না দেখলে এ দৃশ্য বোঝানো যাবে না। আর শীতকালের রং-বেরঙের ফুল গাঁদা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, গোলাপ ইত্যাদি শোভাবর্ধন করে। ফুলের দোকানগুলো বাহারি ফুলে ভরে যায়। এ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথি বরণ করতে ফুলের দোকানগুলোতে নানা রকম ফুলের ডালি, তোড়া ও মালাসহ সুসজ্জিত ফুলের উপকরণ বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়।
পরিযায়ী পাখি ও পর্যটকদের আমেজ : শীতকালে অতিথি পাখির আগমন এক অন্যরকম রোমাঞ্চকর আকর্ষণ। পরিযায়ী পাখিরা বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে এসে আমাদের দেশের হাওর-বাঁওড় ও জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। রং-বেরঙের পাখি দেখে মন ভরে যায়। আর কলকাকলিতে এলাকা মুখরিত হয়। তবে এর মধ্যে কিছু দুষ্ট ব্যক্তি চুরি করে পাখি শিকার করে। যা আমাদের জন্য খুবই কষ্টের কারণ। শীতের অনুকূল আবহাওয়ায় দেশি-বিদেশি ভ্রমণবিলাসী পর্যটকের আগমন ঘটে। বিদেশি পর্যটকদের আগমনে আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রার আয় বেড়ে যায়। এতে অর্থনৈতিক খাত সমৃদ্ধ হয়। দেশের দর্শনীয় স্থান এবং পিকনিক স্পটগুলোতে ভ্রমণকারীদের ঢল নামে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষাসফর শুরু হয়। তা ছাড়া গ্রামের হাট-বাজার এবং উন্মুক্ত স্থানসহ সর্বত্র পিকনিকের আয়োজন বেড়ে যায়।
হাড়কাঁপানো শীতে অসাড় প্রকৃতি : শীতের সকালে গ্রামে কনকনে ঠান্ডা আর ঘন কুয়াশা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। শীতকালে মাঝেমধ্যে শুরু হয় শৈত্যপ্রবাহ। আর এ সময় তাপমাত্রা খুব নিচে নেমে যায়। হাড়কাঁপানো শীতে মানুষ-জীবজন্তুর পাশাপাশি প্রকৃতি যেন অসাড় হয়ে পড়ে। শীতের হাত থেকে বাঁচতে মানুষ আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এ সময় শীতবস্ত্র কেনার ধুম পড়ে যায়। যে যার সাধ্যমতো গরম কাপড় কিনে নিজেকে শীত থেকে সুরক্ষার চেষ্টা করে। শীতের সকাল ও রাতে ছিন্নমূল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা চালায়। শীতের সকালে শহর-গ্রামে আগুনের কুণ্ডলি তৈরি করে উত্তাপ নিতে দেখা যায়। এ আগুন জ্বালিয়ে উত্তাপ নেওয়ার মধ্যে রয়েছে আলাদা এক অনুভূতি। ভবঘুরেরা হাট-বাজার, স্কুল-কলেজের বারান্দায় আশ্রয় খোঁজে। এ সময় সরকার, দানশীল ব্যক্তি এবং বিভিন্ন সংগঠন দুস্থ-গরিবদের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে।
লেখক : সাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী