একসময় ধারণা ছিল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখি বাংলাদেশে আসে। কিন্তু এখন এর ভিন্নমত পাওয়া যাচ্ছে। রাশিয়া ও সাইবেরিয়া থেকে এসব পাখি আসে বলে যে তথ্য প্রচলিত আছে, সেটি ঠিক নয়; বরং পাখিগুলো আসে উত্তর মঙ্গোলিয়া, তিব্বতের একটি অংশ, চীনের কিছু অঞ্চল, রাশিয়া ও সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ উত্তর মেরু, ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু এলাকা এবং হিমালয় পর্বতমালার আশপাশের এলাকা থেকে পাখিগুলো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে আসে। যেখানে তুলনামূলক কম ঠান্ডা পড়ে ও খাবার পাওয়া যায়।
যখন থেকে অতিথি পাখির আগমন : ১৯৮০ সাল থেকে মিরপুর চিড়িয়াখানার হ্রদে অতিথি পাখির দেখা মিলছে। অতিথি পাখির দেখা মিলছে নীলফামারীর নীলসাগর, নিঝুম দ্বীপ, হাকালুকি হাওড়, বরিশালের দুর্গাসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, টাঙ্গুয়ার হাওড়, হাটল হাওড় ও সোনাদিয়ায়। এ ছাড়া অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম স্থান।
১৯ শতাংশ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী : সমগ্র বিশ্বে বাসরত প্রায় ১০ হাজার প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৮৫৫ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী বা যাযাবর। অর্থাৎ শতকরা ১৯ প্রজাতির পাখি সমগ্র বিশ্বের কোথাও না কোথাও পরিযায়ন করে। তার মধ্যে প্রায় ২৩০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ন করতে আসে বাংলাদেশে। দেশি এবং পরিযায়ী মিলিয়ে বাংলাদেশে বিচরণ করে প্রায় ৬০০ প্রজাতির পাখি।
৬ থেকে ১১ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম : সব ধরনের অতিথি পাখিই রাতদিন মিলিয়ে একটানা ৬-১১ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম; যা সম্ভব নয় যান্ত্রিকযান উড়োজাহাজের পক্ষেও। একটা উড়োজাহাজকে ১১ ঘণ্টা হাওয়ায় ভেসে থাকতে হলে দেড়-দুই ঘণ্টার বিরতি নিতে হয়। দেখা যায়, শুধু হাঁস-গোত্রের পাখিরাই ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। সারসদের ক্ষেত্রে দেখা যায় আবার ভিন্ন চিত্র। ওরা একটানা ছয় ঘণ্টা উড়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারে; অপরদিকে প্লোভার গোত্রের পাখিরা একটানা উড়তে পারে ১১ ঘণ্টা। তাতে ওরা পাড়ি দিতে পারে ৮৮০ কিলোমিটার। আলাস্কা অঞ্চলে ‘প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভার’ নামক এক প্রজাতির (বাংলায় নাম সোনাবাটান) পাখির বাস রয়েছে। এসব পাখি প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে হাওয়াই দ্বীপে শীত কাটাতে আসে।
আগমনকারী অতিথি পাখির পরিসংখ্যান : ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে অতিথি পাখি এসেছিল ৮ লাখের বেশি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা নেমে এসেছে দুই লাখের নিচে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে সারা বছর সবমিলিয়ে তিন লাখের মতো অতিথি পাখি আসে।
অতিথি পাখি আসার কারণ : দেশে শীতের সময় জলাশয়গুলোতে পানি কমে যায়। সে সময়ের কচিপাতা, শামুক, ঝিনুকসহ কিছু উপাদান এসব পাখির প্রিয় খাবার। সে কারণে জলাশয়গুলো হয়ে ওঠে তাদের খাবারের উপযোগী স্থান। পাখিগুলো যেখান থেকে আসে, সেখানে শীতে বরফে সব ঢেকে যায়। খাদ্য সংকট তৈরি হয়। সে কারণেই বেঁচে থাকার একটি উপযোগী এলাকা খুঁজতে খুঁজতেই কিছু পাখি এ অঞ্চলে আসে।
অতিথি পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ : বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া নেপালের দুয়েকটি এলাকায়ও এসব পাখি অল্প হলেও দেখা যায়। আবার অতিথি পাখি যেন নিরাপদে বাংলাদেশে অবস্থান করতে পারে, সেজন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কারণে কিছু অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। এসব পাখি শিকার বা হত্যা করা দণ্ডনীয় অপরাধ। বন্যপ্রাণী ও অতিথি পাখি সংরক্ষণের জন্য দেশে অনেক আগে থেকেই আইন রয়েছে, ব্রিটিশ আমলেও বিশেষ আইন ছিল। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন এবং ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল, এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।
জলচর পাখির জন্য ২৮টি স্বীকৃত স্থান : আন্তর্জাতিকভাবে জলচর পাখির জন্য স্বীকৃত ২৮টি স্থান বাংলাদেশের সীমানায় রয়েছে। শীত এলেই এসব এলাকার খাল-বিল, হাওর-বাওর, পুকুর, জলাশয় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এদের কলকাকলিতে। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আসে নাম না জানা এসব পাখি।
যত জাতের অতিথি পাখির আগমন : বাংলাদেশে সাধারণত আসে হাঁস আর সৈকত প্রজাতির পাখি। হাঁস প্রজাতির প্রায় তিন লাখের মতো আর সৈকত প্রজাতির ৫০ হাজার থেকে এক লাখ পাখি এক মৌসুমে আসে। হাঁস প্রজাতির পাখিগুলো হাওড় অঞ্চলে আর উপকূলীয় এলাকা বিশেষ করে সোনাদিয়া দ্বীপ, ঢালচর, চর কুকরী মুকরীসহ কিছু চরে সৈকত প্রজাতির পাখি দেখা যায়। আবার ইউরোপীয় এলাকা থেকে আসা কিছু লালবুকের ক্লাইক্যাসার পাখিও দেখা যায় কখনও কখনও। শুধু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়েই ২০-২৫ প্রজাতির অতিথি পাখি চোখে পড়ে শীতের সময়। ১০ থেকে ১১ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েও পাখি আসে বাংলাদেশে।
উল্লেখযোগ্য অতিথি পাখি : প্রায় তিনশ’ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে বাংলাদেশে। শীতের মৌসুমে আসা পাখিদের মধ্যে রয়েছে বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখপখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়া অন্যতম। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১৫ প্রজাতির হাঁস ছাড়াও গাগিনি, গাও, ওয়েল, পিগটেইল, থাম, আরাথিল, পেলিক্যান, পাইজ, শ্রেভির ও বাটান এসে থাকে।
অতিথি পাখি অনাবাসিক : বাংলাদেশের পাখি দুই শ্রেণির- আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখি অনাবাসিক শ্রেণির আওতায় পড়ে। আবাসিক ও অনাবাসিক মিলে দেশে প্রায় ৬৫০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। যার মধ্যে ৩৬০ প্রজাতি আবাসিক, বাকি ৩০০ প্রজাতি অনাবাসিক। সব অনাবাসিক পাখি শীতের সময় আসে না। ৩০০ প্রজাতির মধ্যে ২৯০টি শীত মৌসুমে আসে এবং ১০টি প্রজাতি থেকে যায়।
অতিথি পাখির শারীরিক গঠন : অতিথি পাখির শারীরিক গঠন খুবই মজবুত। অতিথি পাখি ৬০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ মিটার উঁচু আকাশসীমা পাড়ি দিয়ে উড়ে আসতে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে আর ছোট পাখিরা উড়তে পারে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। দিনরাতে মোট ২৪ ঘণ্টায় তারা প্রায় ২৫০ কিলোমটার পাড়ি দিতে পারে। কিছু পাখি বছরে প্রায় ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে।
৩০ বছর ধরে পেলিকান পাখি খাঁচায় বন্দি : বৃহত্তম পরিযায়ী পাখি হলো পেলিকান; তবে এটি একটি বিরল প্রজাতি। ১৯৯১ সালের শীতকালে নওগাঁ জেলার একটি বিলে পেলিকান পাখি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে শিকারিরা। একটি পেলিকানের শরীরে গুলি লাগে। আরেকটি শিকারিদের হাতে ধরা পড়ে। গুলিতে আহত স্ত্রী পেলিকানকে শিকারিরা খেয়ে ফেলে। তবে সচেতন মানুষ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর সহায়তায় পুরুষ পেলিকানটিকে শিকারিদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে পুরুষ পেলিকানটিকে রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেন ও চিড়িয়াখানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর চিড়িয়াখানার খাঁচায় একাকী তিন দশক কেটে গেছে পাখিটির। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষদের মতে, পেলিকানটির বর্তমান বয়স আনুমানিক ৩৭ বছর।
হামিংবার্ড সবচেয়ে ছোট পাখি : হামিংবার্ড পাখির গড় ওজন ১/৮; এটি সবচেয়ে ছোট পরিযায়ী পাখি। তারা স্থানান্তর করার সময় ৩০ মাইল প্রতি ঘণ্টা (৪৮ কিমি) দ্রুত ভ্রমণ করতে পারে। তাদের অভিবাসন পথ বছরে দু’বার মেক্সিকো উপসাগর জুড়ে নিয়ে যায়। তারা ননস্টপ উড়তে পারে; যা ৬০০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। এত ছোট পাখির জন্য এটি একটি দীর্ঘ ভ্রমণ।