ঢাকা ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

হোমল্যান্ড লাইফের ১০৪ কোটি টাকা লুটের নেপথ্যে মালিকরাই

হোমল্যান্ড লাইফের ১০৪ কোটি টাকা লুটের নেপথ্যে মালিকরাই

জমি কেনা হয়েছে অথচ জমির কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্বহীন এই জমিতে আবার বালু ফেলার খরচও দেখানো হয়েছে। জমি কেনার জন্য অগ্রিম দেয়া হয়েছে অথচ সেই জমি রেজিস্ট্রি হয়নি। ফেরত দেয়নি জমি কেনা বাবদ নেয়া অগ্রিম টাকা। এখানেই শেষ নয়, কোম্পানির সার্ভিস সেন্টারে অগ্রিম কমিশন ও বেতন-ভাতা পাঠিয়ে তা আবার নগদে তুলে নেয়া হয়েছে। এভাবেই হোমল্যান্ড লাইফে গ্রাহকের জমা করা টাকা থেকে লুট করা হয়েছে ১০৪ কোটি টাকা। এ লুটপাট হয়েছে ২০০২ সাল থেকে ২০০৯ সালে। আর এ লুটপাটে জড়িত স্বয়ং কোম্পানির মালিকরাই।

আত্মসাৎকৃত টাকার মধ্যে ৪৪টি সার্ভিসিং সেন্টারের অগ্রিম খরচ পাঠিয়ে ৬১ কোটি টাকা, সিলেটের টুকের বাজারে জমি ক্রয়ের নামে আত্মসাৎ ১ কেটি ৫১ কোটি টাকা, ইনসেনটিভের নামে এসময়ে আত্মসাৎ করা হয় ৭৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৩ টাকা, অস্তিত্বহীন জমিতে মাটি ভরাটের নামে আত্মসাৎ ৩৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা, জমি বিক্রির নামে সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে নিলেন ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, অগ্রিম বাবদ কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদের আত্মসাৎ ২ কোটি ১০ লাখ টাকা, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগে লোকসান ৫ কোটি ১১ লাখ টাকা, পল্লী-পারিবারিক বীমায় অতিরিক্ত ঋণ প্রদান ৩৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা এবং ব্যাংক হিসাবে ১৬ কোটি টাকা ঘাটতি দেখানোসহ মোট ১০৪ কোটি টাকা লুটপাট করার সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি থাকার পরও গ্রাহকের টাকা উদ্ধারে গত ১০ বছরেও কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। উদ্ধার হয়নি কোনো টাকাও। এমননি এ ব্যাপারে বীমা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (আইডিআরএ) কাছে অভিযোগ দিলেও এখনো পর্যন্ত তার কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।

এদিকে ১০৪ কোটি টাকা লুট ও পাচারের বিষয়টি কঠোর নজরদারি করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন- বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে। যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশ পেলে অভিযোগটি অবশ্যই অনুসন্ধান করা হবে। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লুটপাট, পাচারের বিষয়টি দুদক কঠোর নজরদারিতে রেখেছে। এদিকে লুটপাটের এ ক্ষত নিয়েই চলছে হোমল্যান্ড লাইফ। প্রতিনিয়তই হয়রানি, ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রাহক, মাঠ কর্মীরা। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও গ্রাহকরা পাচ্ছে না মেয়াদ শেষে বীমা দাবির টাকা। অপরদিকে লুট হওয়া টাকা কোম্পানির তহবিলে ফেরত আনা নিয়ে পরিচালকদের মাঝে চলছে দ্বন্দ্ব। এ দ্বন্দ্ব নিরসনে কয়েক মাস আগে নিরপেক্ষ পরিচালক নিয়োগ দিয়ে নির্বাচন করা হয়েছে নতুন চেয়ারম্যান। তবে এতেও সুরাহা হয়নি। লুটপাটে জড়িত পরিচালকরা নতুন করে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তুলছে। যাতে করে শতকোটি টাকা দুর্নীতি ধামাচাপা পড়ে এমনটাই অভিযোগ পরিচালনকদের এক পক্ষের। তাদের মতে, গেলো ১০ বছরে কোম্পানিতে যে ফান্ড সৃষ্টি হয়েছে তা আবারও লুটপাট করতেই নতুন নকশা সাজানো হচ্ছে। এমন অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের দাবি অনিয়ম দুর্নীতি নিয়ে সঠিকভাবে তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা। কোম্পানির পরিচালকদের টাকা আত্মাসাতের প্রথম অভিযোগটি ওঠে ২০০৮ সালে। এ সময়ে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এমডি সরাফত উল্লাহ ঢালি কোম্পানির পরিচালক ফয়জুল হকের বিরুদ্ধে ৩০ লাখ টাকা আত্মাসাতের অভিযোগ তুলে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করেন। এই ঘটনায় হোমল্যান্ড লাইফের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের ঘটনা বীমা খাতে আলোচনার জন্ম দেয়।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্যবসা উন্নয়ন খাতে খরচের জন্য ৩০ লাখ টাকার একটি নোট শিট অনুমোদন দেয়া হয় ২০০৮ সালের ১৮ নভেম্বর। এই নোট উপস্থাপন করেন তৎকালিন কোম্পানি সচিব মোয়াজ্জেম হোসেন। নোটটি অনুমোদন করেন কোম্পানির চেয়ারম্যান ফয়জুল হক ও পরিচালনা পর্ষদের নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য। ওই দিনই ২১৬তম বোর্ড সভায় উপস্থিত ছিলেন- ফয়জুল হক, নজরুল ইসলাম, মো. জামাল উদ্দিন, নাফিসা সুলতানা, মো. মহিউদ্দিন, আব্দুর রব, আব্দুর রাজ্জাক, কামাল মিয়া, আব্দুল আহাদ, আব্দুল হাই ও মো. মফিজ উদ্দিন।

বীমা আইনে প্রিমিয়াম আয়ের কমিশন নির্ধারণ করা থাকলে তাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখায় হোমল্যান্ড লাইফের ২০০৮ ও ২০০৯ সালের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় কোম্পানির তৎকালিন সহকারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাকির হোসেন সরকারকে। জাকির হোসেনের সহযোগিতায় ইনসেনটিভের নামে এসময়ে আত্মসাৎ করা হয় ৭৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৩ টাকা। মূলত টাকা আত্মসাতের জন্য কখনো-বা ব্যবহার করা হয় সার্ভিস সেন্টারগুলোকে, কখনো জাকির হোসেন সরকারের মত কর্মকর্তাকে ইনসেনটিভ প্রদান করা হয় অথবা উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল জলিল, নকুল কুমারের মতো ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে অগ্রিম প্রদানের এসব ঘটনা সৃষ্টি করা হয়। যে জমির কোনো অস্তিস্ত নেই। সেই জমি কেনার ব্যয় বাবদ অনুমোদন করা হয় ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা। জনৈক তৈয়ব আলীকে সাজানো হয় জমির মালিক। জমির দাম পরিশোধ করা হয় নগদ চেক ও পে অর্ডারের মাধ্যমে, চার দফায়। অভিযোগ রয়েছে, কথিত জমির মালিক তৈয়ব আলীর পক্ষে এই টাকা গ্রহণ করেন কোম্পানির তৎকালিন পরিচালকরা। এজন্য জমি দেখানো হয় টুকের বাজারের সেই অস্তিত্বহীন জমি। এখানেই শেষ নয়, জমির ক্রয়ের সাব-কবলা দলিল নেওয়া হয় মুরাদ খানের কাছ থেকে। অথচ জমির মূল্য বাবদ ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয় জিন্নুরিন নাহারকে। আর সেই টাকা গ্রহণ করেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম। এই জমি ক্রয়ের এসব অনুমোদন দেওয়া হয় পরিচালনা পর্ষদের ৩৪তম সভা থেকে ৩৯তম সভা পর্যন্ত এই ছয়টি সভায়। জল্লার পাড়ের এ জমি ক্রয়ের কমিশন বাবদ কোম্পানির তহবিল থেকে তুলে নেয়া হয় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর সেই জমির সোলেনামা ডিক্রি, জমির উন্নয়ন, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়ার কথা বলে কোম্পানির তহবিল থেকে নেয়া হয় আরো ১৫ লাখ টাকা। এ টাকা নেন কোম্পানির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল মুনিম শিপু। এ টাকার অনুমোদন দেয়া হয় কোম্পানির ৭৭তম পর্ষদ সভায়।

অনুসন্ধানে সিলেট ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে রেকর্ড পত্রে দেখা যায়, জমিটি হাছন রাজার পরিবারের জিন্নুরিন নাহার রাজা চৌধুরির নামে রেকর্ড করা। এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের জমি আমাদেরই আছে। তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কেউ ভুয়া দলিল পত্র তৈরি করে জমি বিক্রি করেছে কিনা- সে বিষয়টি আমাদের জানা নেই। হোমল্যান্ড লাইফের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনামের ছেলে আরাফাত কাজী। লন্ডনে থাকা এই কাজী আরাফাতের কাছ থেকেই জমি বিক্রির প্রস্তাব এসেছে। এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয় ৩৮তম বোর্ড সভায়। জমি কেনার অগ্রিম বাবদ ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার পরিশোধের অনুমোদনও করা হয় ওই সভায়। এবার জমি ক্রয় করা হবে সিলেট শহরে। এ জমি কিনে দেয়ার নাম করে কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাজী এনাম উদ্দিন আহমেদ কোম্পানির তহবিল থেকে অগ্রিম নেন ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। কিন্তু এ জমি আর কেনা হয়নি। হোমল্যান্ড লাইফের আর্থিক অনিয়ম খতিয়ে দেখতে বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করেন হোমল্যান্ড লাইফ কর্তৃপক্ষ। এই বিশেষ নিরীক্ষক নিয়োগ করা হয় ২০১০ সালে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ওঠে আসে ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর ব্যাংক হিসাবে ১৬ কোটি টাকা ঘাটতির তথ্য।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ব্যাংক বইয়ে যে টাকা জমা দেখানো হয়েছে, ব্যাংক স্টেটমেন্টে ওই পরিমাণ টাকা পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হোমল্যান্ড লাইফের নিরীক্ষা, বিনিয়োগ ও দাবি কমিটির ৭ম ও ৮ম সভায় অডিট রিপোর্ট উপস্থাপিত হলে ব্যাংক স্টেটমেন্টে এই ১৬ কোটি টাকা ঘাটতির বিষয়টিকে আত্মসাৎ বলে মনে করে সভা। ২০১৭ সালের ২১ মার্চ নির্বাহী কমিটির ৩৪৯তম সভায় এবং এর ধারাবাহিকতায় পর্ষদ সভায় কোম্পানির স্থায়ী আমানত নগদায়ন করে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেজে ৫ কোটি ৪১ লাখ ৪২ হাজার ৬৪৯ টাকা বিনিয়োগ করা হয় এবং সেখানে কোম্পানির লোকসান ৩ কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪৯ টাকা। লংকা বাংলা সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হয় ২ কোটি ২১ লাখ টাকা এবং সেখানে ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ১৯৯৮ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত হোমল্যান্ড লাইফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কোম্পানি সচিবের দায়িত্বে ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন ঢালী। তিনি কোন প্রকার যাচাই-বাছাই না করে ৩৪ লাখ ৩২ হাজার ১০০ টাকা ঋণ বিতরণ করেন, যা আদায় হয়নি। এ বিষয়ে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ড. বিশ্বজিৎ কুমার মণ্ডল বলেন, যেসব ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে, তা অনেক আগের। আমি যতদূর জানি, এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তদন্ত করছে। তাই এসব বিষয়ে আমার মন্তব্য করার সুযোগ নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত