ঋণ জালিয়াতি ও পাচার সংকটে ব্যাংকিং খাত। পারস্পরিক যোগসাজশে এক ব্যাংকের পরিচালককে আরেক ব্যাংক থেকে ঋণ দেয়া এবং তা ফেরত না দেয়ার কারণে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক সংকটে পড়েছে। ফলে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। এর বাইরে আছে বিপুল পরিমাণ অবলোপনকৃত ঋণ। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৮ লাখ কোটি টাকা। যা আর্থিক খাতকে সংকটে ফেলে দিয়েছে। সংকট উত্তরণে সরকার নানাভাবে উদ্যোগ নিলেও পুরোপুরি সফল হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ জামাল আহমেদ বলেন, ঋণ নিয়ে যারা পরিশোধ না করে পাচার করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচারের কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে এবং কমছে বৈধ পথে রেমিট্যান্স। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে না। অবিলম্বে ঋণ জালিয়াত চক্র ও অর্থ পাচারকারীদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিতে হবে।
ভুয়া ও বেনামি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে ভুয়া ও বেনামি ঋণ জালিয়াতি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে অবিলম্বে ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে ‘প্রকৃত মালিকানার স্বচ্ছতা’ আইন প্রণয়নের সুপারিশ করে সংস্থাটি। এছাড়া পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেতে দেশে-বিদেশে সব প্রকারের লেনদেনের তথ্য আদান-প্রদান সহায়ক কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডে অবিলম্বে যুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিভিন্ন নামে তৈরি করা ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে অন্যের জমি রেজিস্ট্রেশন করা হয়। ব্যাংকে সে জমির দলিল বন্ধক রেখে নেয়া হয় ঋণ।
এমনকি ব্যাংকে ঋণের জামিনদার হিসেবে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র জমা দেয়া হয় তাও ভুয়া। ভুয়া দলিলের ফাঁদ পেতে চক্র পরিকল্পিতভাবে ব্যাংকের বিপুল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করছে। ব্যাংকে জমা দেয়া দলিল ও অন্যান্য নথি একপর্যায়ে ভুয়া প্রমাণ হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, জমা দেয়া দলিলপত্রে যে জমির আকার ও বিবরণ রয়েছে বাস্তবে সেই জমি অস্তিত্বহীন এবং ঋণ গ্রহণকারী কোম্পানির ঠিকানায় গিয়ে কোম্পানি দূরের কথা, কোম্পানি বা ব্যক্তির নামে কোনো সাইনবোর্ড পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এ বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওইসব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে যথাযথ জামানত সংরক্ষণ করতে।
সরকারি জমির ভুয়া বা জাল দলিল তৈরি করে ঋণ নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও। এভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগে গত বছরের ১৫ এপ্রিল দুজনকে গ্রেপ্তারও করেছিল র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব)। কখনো ভুয়া দাতা, কখনো আবার জমির মালিককে না জানিয়েই জাল দলিল করেছেন তারা। ওই দলিল জামানত রেখেই ব্যাংক থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেয়া হয়েছে। এসব জমি জামানত হিসেবে নিয়ে বিপাকে পড়ছে ব্যাংক। মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করছে জালিয়াত চক্র। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালকরাও একজন আরেকজনের যোগসাজশে ঋণ নিচ্ছেন। নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ না থাকায় তারা এ পথ অবলম্বন করে হাজার হাজার কোটি টাকা বের করে নিচ্ছেন।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সুইস ব্যাংকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ জমা করেছেন বাংলাদেশিরা। গত বছরের ১৬ জুন প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশিদের জমা করা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৭৫ কোটি। যা আগের রেকর্ড অনুসারে সর্বোচ্চ। ২০২০ সালে এটি ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশিদের আমানত দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি ফ্রাঁ ৯৫ টাকা করে ধরলে দেশি মুদ্রায় হয় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। ঠিক এক বছর আগে এ টাকার অঙ্ক ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি। অর্থাৎ এক বছরেই সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা। এদিকে ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যানুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। আর দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর বাংলাদেশের ১ হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। গত বছরের প্রথম নয় মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর বিতরণ মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশই এখন খেলাপি। একই সময় পর্যন্ত বিতরণ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ১৮ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলাপি ঋণের বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া অর্থে বিদেশে বাড়ি কেনা হয়েছে। খেলাপি ঋণের অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় বৈধ পথে প্রবাসী আয়ও কমছে। এখনই ভুয়া ঋণ, খেলাপি ঋণ, দুর্নীতি ও হুন্ডি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া না হলে এ ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ঋণ বিতরণের আগে গ্রহীতার জামানতের দলিল ও প্রতিটি কাগজ ব্যাংকগুলো ভেরিফাই করা হয়। ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও দলিলে ঋণ নেয়ার সুযোগ এখন আর নেই। ভুয়া দলিলে ঋণ নেয়া প্রতারণা। তারপরও এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতারকদের আইনের আওতায় আনছে। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকরা কী কী করতে পারবেন আর কী কী পারবেন না, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা আছে। ঋণ গ্রহণের সময় পরিচালকরা যদি সেই নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটান, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।