আস্থা সংকটে রয়েছে দেশের বিমা খাত। এ সংকটের কারণে অর্থনীতিতে ১ শতাংশের নিচে বিমা খাতের অবদান। শুধু তাই না, বর্তমানে দেশের ৮১ বিমা কোম্পানি গ্রাহকের ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এখনও দিচ্ছে না। এতে নানা সমস্যায় জর্জরিত এ খাতের গ্রাহকরা। আইডিআরএর তথ্য মতে, ২০২২ সালে বিমার সংখ্যা ছিল ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৩৬টি। সে বছরে মোট ৩০ লাখ ৬২ হাজার ৪৬৮টি বিমা দাবি ছিল গ্রাহকদের। এ গ্রাহকদের বিমার টাকার পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৯ লাখ ১২ হাজার ৮৬৯টি বিমার মোট ১০ হাজার ২৬০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ হয়েছে। অর্থাৎ, ২০২২ সালে গ্রাহকদের ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৫৯৯টি বিমা দাবির ৬ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা দিচ্ছে না ৮১টি বিমা কোম্পানিগুলো।
আইডিআরএ তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে ৮১টি বিমা কোম্পানি রয়েছে। এর মধ্যে জীবন (লাইফ) বিমা কোম্পানি রয়েছে ৩৫টি। আর সাধারণ (নন-লাইফ) বিমা কোম্পানি রয়েছে ৪৬টি। এ কোম্পানিগুলোতে গ্রাহকদের বিমার সংখ্যা রয়েছে ৮৮ লাখ ৬৮ হাজার ৪৩৬টি। অথচ ২০২১ সালেও বিমা সংখ্যা ছিল ৯৪ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫টিতে। অর্থাৎ, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৬ লাখ বিমা কমেছে। সাড়ে ১৭ কোটি মানুষ ও দেশের সম্পদের মাত্র ৮৮ লাখ বিমা রয়েছে, যা সম্পদ ও জনসংখ্যার দিক থেকে অতি সামান্য। ২০২১ সালে করোনা মহামারির সংকটের মাঝে বিশ্বব্যাপী মোট বিমা প্রিমিয়ামের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি যেখানে ৩ দশমিক ৪ ভাগে নেমে এসেছিল, সেখানে বাংলাদেশে বিমা প্রিমিয়ামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৩ ভাগ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ০৪ শতাংশ।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষে গ্রস প্রিমিয়ামের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার ৮১২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জীবন বীমার গ্রস প্রিমিয়াম ১১ হাজার ৩৯৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। আর সাধারণ বিমা (নন লাইফ) ৫ হাজার ৪১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা, যা সংকটের এ সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে বড় তারল্যের জোগান দিচ্ছে। লাইফ ও নন-লাইফ বিমা কোম্পানির অর্জিত প্রিমিয়ামের থেকে কর বাবদ ২০২২ সালে ১৩০৫ কোটি ৭৩ লাখ সরকারের কোষাগারে জমা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে এ সময়ে দেশের অর্থনীতিতেও এ খাতের অবদান বেড়েছে। দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ বিমা সাথে সম্পৃক্ত এবং কর্মসংস্থান হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। আর এ সাফল্যে বড় অবদান রেখেছে, এ খাতের নতুন নতুন সব জনবান্ধব ও কল্যাণমুখী বিমা।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিমা দাবি পরিশোধ না করায় প্রতিনিয়তই নতুন বিমার সংখ্যা কমছে। করোনার সময় অর্থাৎ ২০২০ সালে বিমা সংখ্যা ছিল ৯৬ লাখ ৫৪ হাজার, যা গত ২ বছরে সেখান থেকে ৮ লাখ কমে ৮৮ লাখে দাঁড়িয়েছে। সূত্র জানায়, ২০২১ সালে বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ১৩ হাজার ৪৭৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৮ হাজার ৬৫৬ কোটি ২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে কোম্পানিগুলো। গ্রাহকদের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেনি। একইভাবে ২০২০ সালে ছিল বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ৯ লাখ ৭১৭ কোটি ২৩ লাখ টাকার। ওই বছর ৬ হাজার ৬৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার দাবি পরিশোধ করেছে। অর্থাৎ, ৩ হাজার কোটি টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেনি। প্রাণঘাতী করোনার আগের বছর ২০১৯ সালে বিমা দাবির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৮২৮ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধ করেছে ৭ হাজার ৮৪০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তার আগের বছর ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৪৬৫ কোটি ৯১ লাখ টাকার বিমা দাবি ছিল। তার মধ্যে ৭ হাজার ৭৯৮ কোটি ৬ লাখ টাকার বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।
আইডিআরএ‘র তথ্য মতে, যেসব কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধে গাফিলতি করছে সেগুলো হচ্ছে- বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানলাইফ ইন্স্যুরেন্স, সানফ্লাওয়ার ইন্স্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ, পদ্মা ইসলামী লাইফ এবং ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদি। সম্প্রতি এসব কোম্পানির এমডি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা মামলাও করেছে। বেশি কিছু কোম্পানির এমডি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
বিমা দাবি পরিশোধ না করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিমা কোম্পানির মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শেখ করিব হোসেন। তিনি বলেন, বেশ কিছু কোম্পানি বিমা দাবি পরিশোধে গড়িমসি করছে। আমরা এসব কোম্পানির পর্ষদকে অবহিত করব। তারা যেন দ্রুত বিমা দাবিগুলো পরিশোধ করে। তিনি বলেন, অধিকাংশ বিমা কোম্পানি গ্রাহকদের দাবি পরিশোধ করছে। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানির কারণে আমাদের বিমা ব্যবসার সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এটা হতে দেয়া যাবে না।
বিমা নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের প্রেসিডেন্ট বিএম ইউসুফ আলী বলেন, ৩৫টি জীবন বিমা কোম্পানির মধ্যে ২০ থেকে ২৫টি কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবিগুলো যথা সময়ে পরিশোধ করছে। কিন্তু ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানি গ্রাহকদের বিমা দাবি পরিশোধ করছে না। এ কারণে বিমা কোম্পানির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নেতিবাচক। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পাশাপাশি সবারই উচিত তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আইডিআরএ’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বলেন, ৮ থেকে ১০টি কোম্পানির বিরুদ্ধে বিমা দাবি পরিশোধ না করার অভিযোগ রয়েছে। আমরা এ কোম্পানি এমডি-চেয়ারম্যানসহ পরিচালনা পর্ষদকে ডেকে এক মাসের মধ্যে বিমা দাবিগুলো পরিশোধ করতে নির্দেশনা দিয়েছি। তারা যেন কোনোভাবে ফাঁকি দিতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনে সম্পদ বিক্রি করে বিমা দাবি পরিশোধের কথা বলেছি। গ্রাহক যাতে বিমা দাবি নিয়ে ভোগান্তিতে না পড়েন, এর সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এদিকে দেশের অর্থনীতিতে বিমার অবদান বাড়ানো এবং বিমা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রতি বছরের মতো এবছরও জাতীয় বিমা দিবস পালন করছে সরকার। গতকাল বুধবার ‘আমার জীবন আমার সম্পদ, বিমা থাকলে নিরাপদ’ এ প্রতিপাদ্যে বিমা দিবস উপলক্ষ্যে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগ ও বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষে (আইডিআরএ) দেশব্যাপী কর্মসূচির আয়োজন করে।