২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট

ভর্তুকি, সুদ পরিশোধে বাড়ছে বরাদ্দ

প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  অর্থ-বাণিজ্য ডেস্ক

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের ভর্তুকির চাপ অনেক বেশি বাড়ছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প ও ম্যাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি)-সহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ঋণের দায় পরিশোধ শুরু হলে নতুন অর্থবছর সুদ পরিশোধেও বাড়তি ব্যয় হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার সাম্প্রতিক অবমূল্যায়ন এবং লাইবর ও সোফর সুদহার বেড়ে যাওয়াও আগামী অর্থবছরে সরকারের সুদ পরিশোধের সম্ভাব্য ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হবে। ফলে চলতি অর্থবছরের তুলনায় আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষমাত্রা ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৭, ৫৯, ৯৫৫ কোটি টাকার বাজেট প্রণয়নের প্রাক্কলন করলেও- সুদ ব্যয় ও ভর্তুকির চাপ সামলাতেই ব্যয় হবে মোট বাজেটের ২৭ শতাংশ। গত বুধবার (৫ এপ্রিল) অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল অন বাজেট ম্যানেজমেন্ট, কারেন্সি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ রেট’র এক সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের ২২.৯ শতাংশ এ দুটি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ, আগামী অর্থবছরের বাজেটে তা উল্লেখযোগ্য হারেই বাড়ছে। ভর্তুকি ও সুদের পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, বিভিন্ন পণ্য ও সেবায়ও বরাদ্দ বাড়ছে। ফলে সরকারের পরিচালন ব্যয় বেড়ে দাঁড়াবে ৪, ৯৬, ৯৫৫ কোটি টাকায়, যা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি’র ৯.৯ শতাংশ। সে তুলনায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে এটি ছিল জিডিপির ৯.৭ শতাংশ।

ভর্তুকি, সুদ পরিশোধ এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার ফলে এ বছরের মূল বাজেটের তুলনায় নতুন অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বাড়ছে মাত্র ৮ শতাংশ।

৫ এপ্রিল এক সভায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ শীর্ষ নির্বাহীরা উপস্থিত ছিলেন। অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন সভায় চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ও নতুন বাজেটের রূপরেখা উপস্থাপন করেন। নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেটে এডিপিতে ২.৬৩ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১.৬৯ লাখ কোটি টাকা এবং বাকি ৯৪, ০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকছে বৈদেশিক সহায়তা থেকে। নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার জিডিপির ১৫.২ শতাংশ। জিডিপির ৩৩.৮ শতাংশ বিনিয়োগের প্রাক্কলন থাকছে এতে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রাক্কলন করা হয়েছে জিডিপির ২৭.৪ শতাংশ, সরকারিখাতে ৬.৪ শতাংশ। অর্থমন্ত্রী সভায় বলেছেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান প্রধান সূচকগুলো ভালো অবস্থায় রয়েছে। আগামীতে আরও ভালো হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আগামী অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন চলতি অর্থবছরের তুলনায় সহজ হবে। এত বিপুল ভর্তুকির পরও আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুব বেশি সুখবর থাকছে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হচ্ছে ৬ শতাংশ; যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ছিল ৫.৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো- বিবিএসের সর্বশেষ হিসাবে, গত মার্চে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৩৩ শতাংশ এবং এক বছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ৮.৩৯ শতাংশ।

তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খাদ্য ভর্তুকিতে আগামী অর্থবছরে ১, ২০০ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ রাখতে যাচ্ছে। টিসিবির মাধ্যমে এক কোটি পরিবারকে কমমূল্যে খাদ্যপণ্য দেয়াসহ সরকার পরিচালিত খোলা বাজারে বিক্রয় (ওএমএস) এবং ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) কর্মসূচিগুলোর সরবরাহ ঠিক রাখতে এই বাড়তি বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। এছাড়া, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা ও প্রতিবন্ধী ভাতার উপকারভোগীর সংখ্যা ৭.৩৫ লাখ বাড়ানো হচ্ছে। এসব খাতে মাসিক ভাতার হারও বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ তিন ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী খাতে বরাদ্দ থাকছে প্রায় ১.৩০ লাখ কোটি টাকা। এবারের মূল বাজেটে যার পরিমাণ ১.১৩ লাখ কোটি টাকা। ৫ এপ্রিলের ওই সভা শেষে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, মন্ত্রী ও সচিবরা আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। এছাড়া ভর্তুকি, ঋণের সুদ পরিশোধকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন তারা। তিনি আরো জানান, সভায় বিদ্যুৎ সচিব বলেছেন, প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ হারে বাড়ানোর কথা থাকলেও গতমাসে তা বাড়ানো হয়নি। আগামী দুই মাসের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা নেই। তবে সভায় জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তিন মাস অন্তর অন্তর দেশের বাজারে নির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা প্রতিমাসে দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়ে আসলেও আগামী জুলাই থেকে সরকার জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা শুরু করতে পারে বলে জানান তিনি। ‘আগামী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যষ্ফীতির হার ধরা হচ্ছে ৬ শতাংশ; যা বর্তমান হারের তুলনায় কম। কিন্তু, বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আমদানি অর্থায়নের সুদ বাড়লে পণ্যমূল্য আরও বাড়তে পারে’ বলছিলেন অর্থ বিভাগের ওই কর্মকর্তা। তবে আশার কথা হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যের দামও কমছে। এছাড়া, আমানতের সুদহার বাড়লে মানুষ বাড়তি সঞ্চয়ে আগ্রহী হবে। এতে সরবরাহের দিকে ব্যবস্থাপনার কারণে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী অর্থবছর বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি কমে যাবে বলে সভায় আশার কথা শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তিনি বলেছেন, গত দুই মাস ধরে চলতি হিসাবের ঘাটতি কমছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ সরকার-গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে আগামীতে এই ঘাটতি আরও কমে আসবে। এছাড়া, সরকার বিদেশে বেশি মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি ও কয়েকটি ব্যাংক অ্যাপসের মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়ায় রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়বে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

গভর্নর বলেছেন, এবছর অনেক মানুষ কাজ নিয়ে বিদেশে যাওয়ায়, রেমিট্যান্সে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য বাজারে রপ্তানি বাড়ছে। ফলে বাড়তি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী হবে। নতুন অর্থবছরের বাজেটের জিডিপির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। আর জিডিপির আকার নির্ধারণ করা হচ্ছে ৫০, ০৬, ৬৭২ কোটি টাকা। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট কিছুটা কাটলেও নতুন অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রবৃদ্ধি অর্জন করাও চ্যালেঞ্জ হবে বলে অর্থমন্ত্রীকে সতর্ক করে দিয়েছে অর্থনীতিবিষয়ক সরকারের সর্বোচ্চ এই ফোরাম। এদিকে, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আশা করা হলেও সংশোধিত বাজেটে এটি ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রকল্প সহায়তা এবছরই কমে এসেছে। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কাছে এটিও দুশ্চিন্তার কারণ। সরকার মনে করছে, শুধু অবকাঠামো উন্নয়নের মতো কাজে প্রকল্প সহায়তা আসবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য প্রযুক্তির মতো খাতগুলোতে উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনে সহায়তা দিতে আগামী বাজেটে সরকারের কিছু পরিকল্পনা থাকবে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে মোট ৫ লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে অর্থমন্ত্রণালয়। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। আগামী অর্থবছর এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলে তা জিডিপির ১০ শতাংশ হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশেরও কম, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। ঋণের শর্ত হিসেবে আগামী অর্থবছর জিডিপির অনুপাতে ০.৫% রাজস্ব আহরণ বাড়াতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৪.৩০ লাখ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৮.৬ শতাংশ। এটি এবারের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৬.২ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছর এনবিআরকে জিডিপির ৮.৩ শতাংশ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হলেও, সাম্প্রতিকতম তথ্যে দেখা গেছে তা গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্জিত হয়নি।