শহরে বা গ্রামে চতুর্দিক তাকালে ওয়ালে ওয়ালে, সাইনবোর্ডজুড়ে ইকেট্রিক, ইলেক্ট্রনিকস বিজ্ঞাপন। প্রিন্টিং ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়া ঘিরেও এদের প্রচারণা ব্যাপক। বিপণন কেন্দ্রে প্রচারপত্র চোখ ধাধানো পর্যায়ের। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে এরা বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে। সেই বিজ্ঞাপন ব্যয়ের ওপর নির্ধারিত হারে ভ্যাট ট্যাক্স থাকলেও সঠিক হারে পাচ্ছে না সরকার।
দেশে বৃহৎ পরিসরের অনেক ইলেকট্রিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করছে বিভিন্ন আইটেমের ইলেকট্রিক অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক্স পণ্য। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসবের মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রায় প্রথম সারির পর্যায়ে চলে এলেও এরা রাজস্ব দিচ্ছে ছোটো খাটো কোম্পানির আদলে। অভিযোগ উঠেছে রাজস্ব আদায়ে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় নজরদারী নেই বলেই প্রতি বছর বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ ব্যবহার করছে সেসব কোম্পানি।
সাম্প্রতিক সময়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম বেশি উঠে এসেছে এদের মধ্যে অন্যতম এমইপি গ্রুপ, এসকিউ গ্রুপ, মেঘনা স্টার গ্রুপ, আরআর ইম্পেরিয়াল অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক, সুপার স্টার গ্রুপ প্রভৃতি। এসব প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্রান্ডের অন্যান্য পণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ইলেকট্রিক পণ্যও উৎপাদন বিপণন করছে। এদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি ঢাকার বাইরে। এর মধ্যে এমইপি গ্রুপের ফ্যাক্টরি সুদূর বরিশাল এলাকায়, আরএফএল’র ফ্যাক্টরী শায়েস্তাগঞ্জে। আরআর ইম্পেরিয়াল ইলেকট্রোনিক্স জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি। এদের ব্রান্ড আরআর ক্যাবলস। এরা রপ্তানিও করে থাকে বলেও জানা গেছে। তবে রাজস্ব প্রশাসন সঠিক তদন্ত করলে কাঁচামাল আনা ও একই দেশে রপ্তানির মধ্যে অদৃশ্য ঘাপলা আছে কি না, তা বের করতে পারবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেউ আবার বিশেষ সুবিধার জন্য ইকোনমিক জোনে ফ্যাক্টরি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, সুদূর এলাকায় শিল্পায়ন বিস্তারের ইতিবাচক ধারা বজায়ের সাথে রাজস্ব আড়াল করার সুবিধাও ব্যবহার হচ্ছে নানা ভাবে। এসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য সরাঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক পাখা, এলইডি লাইট, বৈদ্যুতিক পাখা, বৈদ্যুতিক ক্যাবলস, ট্রান্সফারমার, সুপার এনামেল ক্যাবল, অ্যালুমনিয়াম কন্ডাক্টর প্রভৃতি। এসবের কাঁচামালের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অ্যালুমনিয়াম, তামা, প্লাস্টিক প্রভৃতি। আমদানি কাঁচামালের পাশাপাশি স্থানীয় বাজার থেকেও কাঁচামাল সংগ্রহ করে ব্যবহার করে কেউকেউ। সে ক্ষেত্রে আমদানি শুল্ক দেয়ার নিয়ম থাকলেও স্থানীয় বাজার থেকে ব্যবহার করা কাঁচামালের ভ্যাট ফাঁকি পড়ছে সবচেয়ে ব্যাপক হারে। স্থানীয় বাজার থেকে অ্যালুমনিয়াম, ও তামার ভাঙারি বা স্ক্রাপ কেনার ক্ষেত্রে প্রায় পুরো ভ্যাটই ফাঁকি পড়ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এসব সঠিক মাত্রায় পরিশুদ্ধ না করে সরাঞ্জাম উৎপাদনে ব্যবহারের কারণে মূল্য বৈষম্য, ভ্যাট ফাঁকিসহ ভয়ানক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।
পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে দুয়েকটা কোম্পানি রয়েছে যাদের রাজস্ব দেওয়ার চিত্র প্রচারণা এবং প্রতিষ্ঠানিক কলেবরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো বাজার প্রতিযোগিতার দিক দিয়ে বড় অবস্থানে থাকলেও রাজস্ব প্রদানের চিত্র ছোটোখাটো কোম্পানির মতো। এরা কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপন দিলেও সেখান থেকেও ভ্যাট ট্যাক্স দিচ্ছে না। এদের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে এসকিউ গ্রুপ, এমইপি গ্রুপের বিজ্ঞাপন। এই ধরনের প্রচারণায় একেকটি প্রতিষ্ঠানে বছরে ১০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হওয়ার কথা উঠছে। তাহলে এদের থেকে রাজস্ব আয়ের চিত্র কেমন হওয়া উচিত সেটি রাজস্ব বিভাগ বিশ্লেষণ করলেই বের করতে পারবে। হাতেগোনা দুয়েকটি কোম্পানিই বড় আকারের রাজস্ব দেবে তা কেনো হবে? শুধু এই খাত নয়, শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিটা খাতে বাজার প্রতিযোগিতার সাথে প্রত্যেককে রাজস্ব প্রদানের প্রতিযোগীতা সমন্বয় করলে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে ব্যাপক হারে। বিষয়টি নিয়ে এসকিউ গ্রুপের চেয়ানম্যান এজেডএম শফিউদ্দিন শামীম জানান, ‘আমরা সরকারকে আগের চেয়ে এখন বেশি রাজস্ব প্রদান করছি। রাজস্ব ফাঁকি দিলে সেটি দেখার দায়িত্ব রয়েছে রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তাদের।’ তিনি বলেন, এই সেক্টরে সবারই ঠিকমতো রাজস্ব প্রদান করা উচিত। অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা বছরে ১০ কোটি টাকার বেশি প্রচারণায় ব্যয় করছি আমাদের নিয়ে এই অভিযোগটিও ঠিক নয়। আমরা পত্রপত্রিকা, টিভিতে বিজ্ঞাপন কম দেই। সারাদেশে ওয়াল পেইন্টিং বিজ্ঞাপন বেশি করি। ওয়াল পেইন্ট বিজ্ঞাপনে খরচ কম হয়। তিনি রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে এনবিআরকে আরো কঠোর ভূমিকায় আসার অনুরোধ করেন।’
কাস্টমস ভ্যাট এডমিন বিভাগের দ্বিতীয় সচিব আবুল বাশার বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশলে নানাভাবে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে চলেছে। বিভাগীয় অফিসগুলো থেকে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা অভিযান হলেও কার্যকরভাবে রাজস্ব ফাঁকি ধরা হচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘বিশাল বিশাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের প্রচার প্রচারণা, বিপণন সবই হচ্ছে প্রথম সারির আদলে কিন্তু ভ্যাট ট্যাক্স দেয়ার বেলায় এদের অবস্থান নেহাত ছোটোখাটো পর্যায়ের।’ তিনি বলেন, ‘এসব প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি রোধ করা গেলে সরকারের রাজস্ব খাতের আয় বাড়বে ব্যাপক হারে।’