ঈদের মাত্র বাকি একদিন। বৈশ্বিক মহামারি করোনার সময়টা বাদ দিলে ঈদের আগের এই সময়টাতে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকা থাকে লোকারণ্য। মানুষের চাপে পা ফেলাই দায় হয়ে পড়ে। সেখানে এখন অনেকটাই সুনসান নীরবতা। ভিড়ে-ভিড়াক্কার পরিস্থিতিতে ক্রেতার চাপ সামলানোর ব্যস্ততা নেই। একরকম অলস সময় কাটাচ্ছেন দোকানের মালিক-কর্মচারীরা। রাতে কিছুটা বেচা-বিক্রি হলেও দিনে দেখা মিলছে না ক্রেতার। অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না।
সম্প্রতি নিউমার্কেট লাগোয়া ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আর তীব্র দাবদাহের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন দোকানিরা। গত মঙ্গলবার ও গতকার বুধবার দুপুরে নিউমার্কেটের ২ নম্বর গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে হাতের বাম দিকে একটু এগুতেই দেখা গেল সুনসান নীরবতা। সারি সারি দোকানগুলোর সামনে চেয়ার ফেলে বসে আছেন দোকান কর্মচারীরা।
ঈদবাজারে যেখানে ক্রেতারা বারবার জিজ্ঞাসা করেও বিক্রেতার মনোযোগ আকর্ষণে হিমশিম খান সেখানে উল্টো চিত্র। সামনে দিয়ে দুয়েকজন হেঁটে যেতে দেখলেই চেয়ারে বসে থাকা কর্মচারীরা বলে উঠছেন- ‘কী লাগবে ভাই, আমাদের দোকানে আসেন, এখানে সব আছে।’ ললিতা শাড়ীজ নামের একটি দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া সময় দোকান কর্মচারী হাত উঁচু করে বলতে থাকেন- আমাদের দোকানে আসেন ভাই। এখানে সব আছে। কাছে গিয়ে জানা গেলো তার নাম মোহাম্মদ সোহেল।
সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হলো সোহেলের সঙ্গে। বেচা-বিক্রি কেমন হচ্ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এবারে একদমই বেচাকেনা নেই ভাই। ঈদের বাজার। অথচ সারা দিনে যা বেচাবিক্রি হয় তা দিয়ে আমাদের ইফতারির খরচও ওঠে না। এই গরমে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। তার ওপর আছে আতঙ্ক। ‘আগুন লাগছে নিউ সুপার মার্কেটে। আর মানুষ ভাবছে পুরো নিউমার্কেটে আগুন লাগছে। তাই কাস্টমাররা এবার নিউ মার্কেটে আসছে না। তবে রাতে কিছুটা বেচা-বিক্রি হয়।’
কাপড়ের দোকান শাহি স্টোরের কর্মচারী রিপনের কণ্ঠেও হতাশার সুর। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে এখনও কিছু বেচাবিক্রি হয়নি। কখন হবে তাও জানি না। অথচ আগে এইরকম সময় আপনার সাথে কথা বলারও আমাদের সময় ছিলো না। কথা তো দূরে থাক, দোকানে ভিড়ের কারণে দাঁড়াতেই পারতেন না। অথচ আজ দেখেন পুরো দোকান ফাঁকা। শুধু আমার দোকানই না, আশপাশের সব দোকানেই কাস্টমার নেই। যা কাস্টমার আছে সেগুলো এই ফুটপাত থেকেই কিনে চলে যাবে। দোকানে ঢুকবে না।’
কথা হয় নিউমার্কেটে কেনাকাটা করতে আসা তরিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বাসা মোহাম্মাদপুরে। এবার ঈদের কেনাকাটা প্রায় সবটাই আমি টোকি স্কয়ার আর কৃষি মার্কেট থেকে করে ফেলেছি। আজকে (মঙ্গলবার) আমার আজিমপুরে একটু কাজ ছিলো। এইদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এখান থেকে একটু ঘুরে যাচ্ছি। যদি মনমতো কিছু পাই কিনব না হলে কিনব না।’
ঢাকা নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ঈদের সময় আমাদের অন্যরকম প্রত্যাশা থাকে। বিশেষ করে রোজার মাসের শেষ দুই সপ্তাহ এই প্রত্যাশা থাকে কয়েক গুণ বেশি। আগে এই সময়ে বিক্রিও হতো অনেক বেশি। কিন্তু গত কয়েক বছর নানা কারণে বেচা-বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। কয়েক বছর গেলো করোনা। তারপর গত বছর ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে আমাদের কর্মাচারীদের মারামারিতে কমে যায় বেচাকেনা। আর এবার আবহাওয়া গরম আর আগুন সবকিছু থমকে দিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গরম আর আগুন আতঙ্কে মানুষ এই মার্কেটে কম আসছে। তাছাড়া এখন প্রায় প্রতিটি এলাকায়ই ছোট-বড় মার্কেট হয়ে গেছে। মানুষ সেখান থেকেও কেনাকাটা করছে। তবে দিনে মানুষ কম এলেও রাতে কিছুটা বেচাবিক্রি হচ্ছে।
শুধু নিউমার্কেট নয়, ঈদের সময় চরম ব্যস্ততায় সময় কাটানো গাউসিয়া মার্কেটেও এবার ক্রেতা অনেক কম। বেশিরভাগ দোকানই ফাঁকা। দোকান মালিক-কর্মচারী আড্ডা মেরে সময় কাটাতে দেখা গেছে।
মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত পাঠান বাজার নামের শাড়ির দোকানের রাব্বি নামে এক কর্মচারী বলেন, ‘গত বছর যদি আমরা সারাদিনে দেড় লাখ টাকা বেচাবিক্রি করতাম এখন সেখানে মাত্র ১০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করছি।’
বাতায়ন শাড়ি নামের দোকানের কর্মচারী সানা দেয়ান বলেন, ‘এখন আমরা আপনারে ডেকে গল্প করছি আর আগে আপনি ডাকলেও আমরা শুনতাম না কাস্টমারের চাপে। এখন আমরা দর-দাম করি। আর আগে কাস্টমারকে বলতাম- এই দামে বেচবো; আপনি নিলে নেন না নিলে চলে যান। আরেক কাস্টমারকে এখানে আসার সুযোগ দেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বুঝতেছি না কাস্টমাররা কই যাইতাছে। কেউ তো আর কেনাকাটা বন্ধ করে দেয় নাই। কেনাকাটা তো ঠিকই চলতাছে। আমার ধারণা মানুষ অনলাইন আর নিজের এলাকাতেই কেনাকাটা শেষ করে ফেলছে। তাই এখানে কাস্টমার কম।’
একইরকম হতাশার কথা বললেন হর্কাস মার্কেট আর চন্দ্রিমা সুপার মার্কেটের ব্যাবসায়ীরা। তাদেরও একই কথা- ‘বেচাবিক্রি নাই।’