কৌশলে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে অধিকাংশ ইলেকট্রিক কোম্পানি

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  অর্থনৈতিক প্রতিবেদক

দেশে বৃহৎ পরিসরের প্রচারণা করা ইলেকট্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই কৌশলে সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চলেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ইলেকট্রিক মার্কেটগুলোয় সবচেয়ে বেশি রাজস্ব ফাঁকি পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, বৈদ্যুতিক সরাঞ্জাম উৎপাদনকারী অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলো ভ্যাট চালান ইস্যু করছে ঠিকই কিন্তু তা ট্রেজারিতে জমা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে রেয়াদ সুবিধাও নেয়া হচ্ছে। এখানে দোকানদাররা বা উৎপাদনকারী কী পরিমাণ মালামাল বিক্রি করছেন, সে বিষয়ে রাজস্ব প্রশাসনের কার্যকরি ভেরিফিকেশন এবং অডিট না থাকার কারণে ভ্যাট ফাঁকির মাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে অসাধু শ্রেণির কিছু প্রতিষ্ঠান ফুলে ফেপে বিশাল অর্থের মালিক বনে যাচ্ছে। আর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পড়ে সঠিক হারে ভ্যাট দেয়া বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব শোরুম এবং বিভিন্ন দোকানে মালামাল সরবরাহ দেয়ার ক্ষেত্রে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগ থাকলেও প্রশাসনের জোরাল ভূমিকা না থাকায় এটি বেড়েই চলেছে বলে মনে করছে বিজ্ঞ মহল।

অভিযোগ উঠেছে, দেশের অন্যান্য ইলেকট্রিক মার্কেটের পাশাপাশি রাজস্ব ফাঁকিতে সবচেয়ে বেশি ড্যাম কেয়ার অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রামের বৈদ্যুতিক পণ্যের বাজার। এখানে বিশাল ইলেকট্রিক বাজারে ডিসকাউন্ট, কমিশন এবং বিদেশ ভ্রমণসহ বিভিন্ন লোভনীয় অফারের আড়ালেও রয়েছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকির ইশারা। জানা গেছে, এখানে হাতেগোনা দুয়েকটি কোম্পানি ছাড়া ইলেকট্রিক সরাঞ্জাম বিক্রয় ক্ষেত্রে কেউ সঠিক হারে ভ্যাট ট্যাক্স দিচ্ছে না। মাঝেমধ্যে রাজস্ব বিভাগের দুয়েকটি অভিযান হলেও কিছুদিন পর আবার চলতে থাকে আগের অবস্থা। ইলেকট্রিক পণ্য সরবরাহে ভ্যাট চালান সঠিকভাবে যাচাই করে দেখলেই রাজস্ব ফাঁকির চিত্র বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, চট্টগ্রামের ইলেকট্রিক মার্কেটে এসকিউ, এমইপি, এলকো, আরআর, বিবিএস, বিজলী, পলি, মেঘনা স্টার, পার্টেক্স ক্যাবলসসহ বিভিন্ন কোম্পানির শত শত কোটি টাকার ক্যাবলস, ফ্যান, বালব, সুইস, সার্কিটসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক মালামাল বিক্রয় হচ্ছে।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ইলেকট্রিক দোকানগুলোর মধ্যে সাতকানিয়া ইলেকট্রিক, মোস্তফা ইলেকট্রিক, লাঙ্গলকোর্ট ইলেকট্রিক, আশিকা ইলেকট্রিক, আল রাজ্জাক ইলেকট্রিক, হাটহাজারি ইলেকট্রিক, হেদায়েত ইলেকট্রিক, লিয়াকত ইলেকট্রিক, নিউ রাজ এন্টারপ্রাইজ, সাইফুল ইলেকট্রিক, হোসেন ইলেকট্রিক, এনএন ইলেকট্রিক, মিশুক ইলেকট্রিকসহ কয়েকশ দোকান রয়েছে। এছাড়া প্রায় প্রত্যেক ইলেকট্রিক কোম্পানির নিজস্ব শোরুম বা সেলস সেন্টার রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে রাজস্ব প্রশাসনের সংশিষ্ট নির্বাহীরা নিয়মিত অভিযানের মাধ্যমে কাগজপত্র পর্যবেক্ষণ করে অফিসের মূল ভ্যাট চালানের সাথে মিলালেই সঠিক ফাঁকির তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করছে অভিজ্ঞমহল। জানা গেছে, ভ্যাট গোয়েন্দাদের অভিযানে জরিমানা থেকে বাচতে প্রদর্শনেন জন্য কৌশলে অনেকে ভুয়া ভ্যাট চালান বানিয়ে কাছে রাখে।

অন্যদিকে পুরো বাংলাদেশের শহরে বা গ্রামে চতুর্দিক তাকালে ওয়ালে ওয়ালে, সাইনবোর্ড জুড়ে ইকেট্রিক, ইলেক্ট্রনিকস পণ্যের বিজ্ঞাপন। প্রিন্টিং ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়া ঘিরেও এদের প্রচারণা ব্যাপক। বিপণন কেন্দ্রে প্রচারপত্র চোখ ধাঁধানো পর্যায়ের। লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা ব্যায় করে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে। সেই বিজ্ঞাপন ব্যায়ের ওপর তো নির্ধারিত হারে ভ্যাট ট্যাক্স থাকার কথা। সরকার কি সেখান থেকে সঠিক হারে রাজস্ব পাচ্ছে?

এদের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি ঢাকার বাইরে। এর মধ্যে এমইপি গ্রুপের ফ্যাক্টরি সুদুর বরিশাল এলাকায়, আরএফএল’র ফ্যাক্টরি শায়েস্তাগঞ্জে। আরআর ইম্পেরিয়াল ইলেকট্রোনিক্স জয়েন্টভেঞ্চার কোম্পানি। এদের ব্রান্ড আরআর ক্যাবলস। কেউ আবার বিশেষ সুবিধার জন্য ইকোনমিক জোনে ফ্যাক্টরি করেছে। অভিযোগ রয়েছে, সুদূর এলাকায় শিল্পায়ন বিস্তারের ইতিবাচক ধারা বজায়ের সাথে আড়ালে রাজস্ব আড়াল করার সুবিধাও ব্যবহার হচ্ছে নানা ভাবে। এসব প্রতিষ্ঠানের ইলেকট্রিক সরাঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বৈদ্যুতিক পাখা, এলইডি লাইট, বৈদ্যুতিক ক্যাবলস, ট্রান্সফারমার, সুপার এনামেল ক্যাবল, অ্যালুমুনিয়াম কন্ডাক্টর, সুইস সকেট, সার্কিট ব্রেকার প্রভৃতি। এসবের কাঁচামালের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এলুমনিয়াম, তামা, প্লাস্টিক প্রভৃতি।

এ বিষয়ে এসকিউ গ্রুপের চেয়ানম্যান এজেডএম শফিউদ্দিন শামীম বলেন, ‘আমরা সরকারকে আগের চেয়ে এখন বেশি রাজস্ব প্রদান করছি। রাজস্ব ফাঁকি দিলে সেটি দেখার দায়িত্ব রয়েছে রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তাদের।’ তিনি বলেন, ‘এই সেক্টরে সবারই ঠিকমত রাজস্ব প্রদান করা উচিত।’ অন্যপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা বছরে ১০ কোটি টাকার বেশি প্রচারণায় ব্যয় করছি, আমাদের নিয়ে এই অভিযোগটিও ঠিক নয়। আমরা পত্রপত্রিকা, টিভিতে বিজ্ঞাপন কম দিই। সারাদেশে ওয়াল পেইন্টিং বিজ্ঞাপন বেশি করি। ওয়াল পেইন্ট বিজ্ঞাপনে খরচ কম হয়।’ তিনি রাজস্ব ফাঁকি বন্ধে এনবিআরকে আরো কঠোর ভূমিকায় আসার অনুরোধ করেন। এ বিষয়ে কাস্টমস ভ্যাট অ্যাডমিন বিভাগের দ্বিতীয় সচিব আবুল বাশার বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশলে নানাভাবে ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে চলেছে। বিভাগীয় অফিসগুলো থেকে মাঝেমধ্যে দুয়েকটি অভিযান হলেও কার্যকরভাবে রাজস্ব ফাঁকি ধরা হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিশাল বিশাল কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের প্রচার প্রচারণা, বিপণন সবই হচ্ছে প্রথম সারির আদলে কিন্তু ভ্যাট ট্যাক্স দেয়ার বেলায় এদের অবস্থান নেহাত ছোটোখাটো পর্যায়ের।’ তিনি বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি রোধ করা গেলে সরকারের রাজস্ব খাতের আয় বাড়বে ব্যাপক হারে।