ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাজেটে এফবিসিসিআই’র শুল্ক-কর প্রস্তাবনা

বাজেটে এফবিসিসিআই’র শুল্ক-কর প্রস্তাবনা

আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারের বিবেচনার জন্য ব্যবসায়ীদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এফবিসিসিআই শুল্ক-কর রাজস্ব বিষয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে জাতীয় শুল্কনীতি প্রস্তাবনা বাস্তবায়ন, বাজেট ২০২৩-২০২৪: রাজস্ববিষয়ক এফবিসিসিআই’র সাধারণ প্রস্তাবনা বিনিয়োগ, দেশীয় শিল্প ও সেবা ও সিএমএসএমইকে শুল্ক-করের যৌক্তিক প্রতিরক্ষণ, ক্ষেত্র বিশেষে অব্যাহতি বা বন্ড সুবিধা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ভিত্তিতে রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণসহ দেশজ উৎপাদন অব্যাহত রাখা, নিত্যব্যবহার্য পণ্যমূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা, করনীতি, কর পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা আধুনিকীকরণের মাধ্যমে করনেট বা করজাল সম্প্রসারণ ও স্বেচ্ছায় কর পরিপালন হার বৃদ্ধি করে রাজস্ব আদায় তথা কর জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধি ও আয় এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস করা- জাতীয় স্বার্থেই অপরিহার্য। এ উদ্দেশেই এসব প্রস্তাবনা পেশ করা হয়।

প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে-

প্রস্তাবনং ১ : (ক) কর হার কমিয়ে আয়কর এবং মূসকের আওতা সম্প্রসারণ করে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সব ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে আয়কর ও মূসকের আওতায় নিবন্ধনের নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট কর কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন বাণিজ্য ও পেশাজীবী সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক, লাইসেন্স ও নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করার বিশেষ বিধান করতে হবে।

(খ) সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ধরনের কাজে হালনাগাদ টিআইএন নম্বর ও কর পরিশোধের প্রমাণ দাখিল বাধ্যতামূলক করতে হবে।

(গ) সব উদ্যোক্তার কর নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করে বিনিয়োগের প্রামানিক দলিল হিসাবে গণ্য করা। এ বিষয়ে এফবিসিসিআই’র যুক্তি হচ্ছে, কর হার কমিয়ে করের আওতা বাড়িয়ে কর প্রদান প্রক্রিয়া সরল ও সহজ এবং ব্যবসাবান্ধব করা হলে করদাতা কর প্রদানে আগ্রহী এবং সচেতন হবেন। ফলে কর প্রাপ্তি ক্রমাগত হারে বেড়ে যাবে। কর প্রবৃদ্ধির আর কোনো বিকল্প পথ নাই।

প্রস্তাবনং ২ : শুল্কায়ন, পণ্য খালাস এবং সকল প্রকার শুল্ক ও কর পরিশোধ ত্বরান্বিত করার জন্য অনলাইন প্রক্রিয়াসহ বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো সংক্রান্ত কার্যক্রম বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রেড ফ্যাসিলিটেশান চুক্তি অনুযায়ী মুদ্রিত নথিপত্র কিংবা ইলেকট্রনিক নথি উভয় পদ্ধতিতে দাখিলের সুযোগ প্রদান করে সব শ্রেণির উদ্যোক্তাদের জন্য অবারিত করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৩ : বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রেড ফ্যাসিলিটেশান চুক্তির ২.১ ও ২.২ ধারা, বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা এর বিধিবিধানসহ বিশ্বব্যাপী অনুসৃত সর্বোত্তম নীতমালার আলোকে কাস্টমস অ্যাক্ট, মূসক আইন, এবং আয়কর অধ্যাদেশ স্টেকহোল্ডারদের সাথে অংশীদারিত্ব এবং পরামর্শক্রমে সংশোধন ও আধুনিকায়ন করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৪ : উৎপাদন, আমদানি ও রপ্তানি পর্যায়ে আরোপিত সকল শুল্ক ও কর এবং খালাস প্রক্রিয়া বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব কাস্টমস সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উত্তম ব্যবস্থাবলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৫ : ঝুঁকি-ব্যবস্থাপনা কার্যকর এবং জোরদার করে ফাঁকি দেয়া কর আদায়ের জন্য প্রণোদনা হিসাবে নিয়মিত স্কেলের বেতন ভাতাদি ছাড়াও কর কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত বিশেষ কমিশন প্রদান করার বিধান বাতিল করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৬ : রাজস্ব আহরণ এবং রাজস্ব পলিসি কার্যক্রম পৃথক করে ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন বিভাগ গঠন করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৭ : বাংলাদেশের রুলস অফ বিজনেস এবং এলোকেশান অব বিজনেস অনুযায়ী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন, ট্যারিফ পলিসি, ট্যারিফ মূল্যায়ন, ট্যারিফ প্রেফারেন্স, ট্যারিফ সংক্রান্ত সাধারণ এবং আন্তর্জাতিক চুক্তি ইত্যাদিসহ বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন (সংশোধন) আইন ২০২০ এর ৭ (১) এবং ৭ (৪) উপধারার উদ্দেশ্য পূরণ করার দায়িত্ব পূরণকল্পে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশক্রমে জাতীয় শুল্কনীতি আদেশ প্রণয়ন করা এবং তা মন্ত্রী পরিষদের বিবেচনা ও অনুমোদনক্রমে গেজেট আকারে জারী করা। আবশ্যিকভাবে পালনীয় চলমান এই আদেশের অধীনে জাতীয় বাজেট প্রণয়ণ এবং রাজস্ব হার ধার্য ও প্রয়োগ করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৮: রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যয় এবং সময় কমানোর জন্য রপ্তানি পণ্যে ব্যবহৃত আমদানিকৃত এবং দেশীয় উপকরণের উপর পরিশোধিত সকল শুল্ক ও কর পূর্ব স্থিরকৃত হারে রফতানি মূল্য প্রাপ্তি সাপেক্ষে একক বিভাগ মারফত স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাৎক্ষণিক ফেরত প্রদান করা এবং খরচ এবং সময় কমানের জন্য রপ্তানি খাতসহ শিল্প বাণিজ্য খাতে উৎস ও আগাম কর ফেরত দেয়ার পরিবর্তে রহিত করতে হবে।

প্রস্তাব নং ৯ : উৎপাদনশীল এবং রপ্তানিমুখী গ্রামীণ ও ক্ষুদ্র শিল্পসহ নারী উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে খাতভিত্তিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌথ ব্যবস্থাপনায় বন্ডেড ওয়্যার হাউজ এবং বিতরণ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে ই-কমার্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করতে হবে।

প্রস্তাব নং ১০ : উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধির সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট সব রপ্তানি এবং শিল্প খাতে করমুক্ত রেয়াতি হারে বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদি সরবরাহের সংস্থান করতে হবে।

প্রস্তাব নং ১১ : অ) ফ্ল্যাট ও প্লট রেজিস্ট্রেশন সংশ্লিষ্ট ফি ও করসমূহ হ্রাস করে ৫% হার নির্ধারণ করা। যা নিম্ন-বর্ণিত হার হিসাবে করা যেতে পারে: ক. গেইন ট্যাক্স ২%, খ. স্ট্যাম্প ফি ০.৫%, গ. রেজিস্ট্রেশন ফি ০.৫%, ঘ. স্থানীয় সরকার কর ১% ঙ. মূল্য সংযোজন কর ১% সর্বমোট: ৫%

আ) রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প ডিউটি, গেইন ট্যাক্স ইত্যাদি বিদ্যমান হার হ্রাস করে সব মিলিয়ে মাত্র ২% হারে দ্বিতীয় বার ফ্ল্যাট/প্লট ক্রয় বিক্রয় এর ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। ফলে একই সম্পত্তি একাধিকবার হাত বদলের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে এবং দেশে আবাসন শিল্পের জন্য ‘সেকেন্ডারি বাজার’ সৃষ্টিসহ উন্নত দেশের মতো ‘রিয়েল এস্টেট মার্কেট’ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে।

প্রস্তাব নং ১২ : (১) মুদ্রা পাচারে সহায়ক ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চা পরিপন্থি বিদ্যমান ট্যারিফ মূল্য ও মিনিমাম ভ্যালু সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপণ রহিত করে সে জায়গায় বিনিময় মূল্য সিস্টেম চালু করতে হবে।

(২) রপ্তানির বৈচিত্র্যকরণের সুবিধার্থে স্পেশাল বন্ড সুবিধা, প্রচ্ছন্ন রপ্তানিকারকদের প্রদত্ত বন্ড সুবিধার বাইরে অবস্থিত রপ্তানিকারকদের জন্য কেন্দ্রীয় বন্ড ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।

(৩) কিয়োটো কনভেনশন, ডব্লিউটিও এবং টিএফএ-এর আলোকে বাংলা ভাষায় প্রণীত ও অগ্রাধিকার মূলক নতুন কাস্টমস অ্যাক্ট আগামী বাজেট অধিবেশন পাস করার লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রস্তাব করা যায়। উক্ত আইন সংসদে পাস হওয়ার ১ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

(৪) কাস্টমস ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সিস্টেম এ্যাসাইকুডায় বিভিন্ন বিষয় ডিজিটাল পদ্ধতিতে আনার উদ্যোগ নিশ্চিত করা। এতে দ্রুত পণ্য খালাস হবে এবং মিথ্যা ঘোষণা, হয়রানি, শুল্ক ফাঁকি, দুর্নীতি হ্রাস পাবে।

(৬) কর অব্যাহতি- পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই না করে সব খাতে কর অব্যাহতি সুবিধা দেয়া হয়েছে- সেসব খাতের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, প্রদত্ত অব্যাহতির প্রভাব, অব্যাহতির মেয়াদ, অব্যাহতির রাজস্ব গুরুত্ব যাচাই না করে জাতীয় অর্থনীতির সংকটের সময় এসব বিষয়ে অত্যন্ত সতকর্তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

উল্লেখ্য, কর অব্যাহতি তুলে দিয়ে যে রাজস্ব পাওয়া যাবে- রাজস্ব বিভাগ তার বিদ্যমান নীতি, ব্যবস্থাপনা, বাস্তবায়ন পদ্ধতি আরো আধুনিক করে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি রাজস্ব তাদের তিন আইনের আওতাধীন বর্তমানের করযোগ্য খাত হতে আদায় করা সম্ভব হবে।

(৭) জমি ক্রয়, নির্মাণ এবং শিল্প ও সেবা খাতের ইউটিলিটি বিলসহ সব উৎপাদনশীল খাতে প্রদেয় যাবতীয় প্রশাসনিক সেবা সম্পূর্ণরূপে পরোক্ষ মুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রস্তাবনার প্রেক্ষাপট এবং উদ্দেশ্য: এলডিসি হতে উত্তরণ পরবর্তীতে কাস্টমস, মুসক ও আয়কর সংক্রান্ত যেসব বিধিবিধান ও পদ্ধতি ডব্লিউটিও/ডব্লিউসিও এবং আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ থাকবে না, সেগুলো চিহ্নিতকরণ এবং প্রয়োজনীয় আইনি ও পদ্ধতিগত সংস্কারের লক্ষ্যে সুপারিশ প্রণয়ন; রাজস্ব প্রশাসনে ব্যবসাবান্ধব ও করদাতা সহায়ক প্রয়োজনীয় সংস্কারের ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিতকরণ; অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ জোরদারকরণ; আমদানি শুল্ক, আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর বিষয়ে বিদ্যমান বিধি-বিধান ব্যবসা এবং শুল্ক-কর বান্ধব সংস্কারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে এই সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। এফবিসিআইয়ের অধিভূক্ত দেশের চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এবং খাতভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনের শুল্ক ও রাজস্ব নীতিবিষয়ক আমদানি শুল্ক, মূসক এবং আয়কর সংক্রান্ত সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনাক্রমে এই প্রস্তাবনা প্রণীত হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত