দেশে বৈদেশিক মুদ্রার একক দাম চালু জুলাইয়ে
* খেলাপি ঋণ মোকাবিলার পর্যায়ে নেই বাংলাদেশ ব্যাংক * আমানত বাড়ছে, কমছে ঋণ বিতরণ’ * দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করেন
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
আগামী জুলাই থেকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার (বিশেষ করে ডলার) একক দাম চালু হতে যাচ্ছে। একই সঙ্গে দাম নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল সোমবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের অফিসে ব্যাংক খাত নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেড (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন। এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, সুদের হার বাজারভিত্তিক হওয়া কতটুকু প্রয়োজন তা নিয়ে চিন্তা করা উচিত। ৬ ও ৯ শতাংশ হারে যে সুদহার বেধে দেয়া হয়েছিল তা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়তা করেছে। এখন আসছে মুদ্রানীতিতে যদি সুদহারে ক্যাপ তুলে দেয়া হয় তারপরও তা বাজারভিত্তিক হবে না বলে মনে করে এবিবি। তবে এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, গেল বছরের থেকে এখন স্বস্তিতে ফিরছে দেশের ব্যাংক খাত। দুই কিংবা একটি ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকে ডেফার পেমেন্ট বাকি নেই। তবে ২০১৮ বা ২০১৯ সালের মতো অবস্থায় আসতে এখনো বেশ সময় লাগবে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে তিনি বলেন, ২০২২ সালে বহির্বিশ্বের কারণে দেশে যে অর্থনৈতিক মন্দা, সামষ্টিক অর্থনীতির যে চাপ, রিজার্ভের যে সংকট গেছে তা গেল ৩৫ বছর দেখেনি দেশের ব্যাংক খাত। গেল বছরের জুন-জুলাইয়ে ভয়াবহ মন্দাতে গেছে দেশ। এ বছরেই টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ যা অকল্পনীয়। ডলার সংকট কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি শুরু করায় মূলত তারল্য সংকট দেখা দেয়।
রেমিট্যান্সের বিষয়ে এবিবি চেয়ারম্যান বলেন, রেমিট্যান্সের ডলারের শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কি ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে তাও দেখতে হবে। প্রবাসীরা এয়ারপোর্টে ভালো সুবিধা পান না, তাদের কোনো ধরনের কাজ সম্পর্কে শেখানো হয় না। অন্যান্য দেশে বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং দেয়া হয়, দক্ষ করা হয়, যা আমাদের দেয়া হয় না। এতে প্রবাসীরা অনেক পিছিয়ে পড়ছে। এছাড়া খেলাপি ঋণের বিষয়ে তিনি বলেন, সংকটের মধ্যেও কোনো ব্যাংকের আমানতকারীরা টাকা তুলতে পারেনি এমন হয়নি। তারল্য ব্যাংক খাতের কোনো চ্যালেঞ্জ না। দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এছাড়া এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ীরা টাকা পাচার করেন। আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয়েছে। আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হয় এটা আমরা জেনেছি গত দেড়-দুই বছর আগে। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই এ পদ্ধতিতে টাকা পাচার হয়েছে। আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে টাকা পাচারের সুযোগ রয়েছে, যার সবগুলো উপায় ব্যাংকাররা জানেন না। সেই সুযোগ এ পর্যন্ত মানি লন্ডারিং হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি এলসি নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের কারণে গত বছর থেকে এর হার অনেক কমে এসেছে।
নন পারফরমিং লোন (এনপিএল) বা খেলাপি ঋণ নিয়ে এবিবির চেয়ারম্যান বলেন, ব্যাংক খাতের শুরু থেকেই এনপিএল বাড়ন্ত ছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক নির্দেশনায় এনপিএল কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা ব্যাংকগুলো কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
ব্যাংক খাতে আমানত বাড়ছে, কমছে ঋণ বিতরণ’ : দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। করোনার পর ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চলা অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুরু করছে ব্যাংকিং খাত। ফলে আমানত বাড়ছে কিন্তু সে তুলনায় ঋণ বিতরণ কমেছে বলে জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ লিমিটেডের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন।
তিনি বলেন, করোনার পর ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে চলা অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠতে শুরু করছে ব্যাংকিং খাত। ফলে আমানত বাড়ছে কিন্তু সে তুলনায় কমেছে ঋণ বিতরণ। এ কারণে বর্তমানে প্রয়োজনের চেয়ে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। সিটি ব্যাংকের এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, এখনো আমাদের এলসি খোলার সমস্যা কাটেনি। ছোট ছোট এলসিগুলো খুলতে পারছি না। আমাদের কাছে ১০টি এলে হয়তো চারটি এলসি খুলতে পারছি। আমরা গুরুত্ববহ পণ্য আমদানির জন্য এলসি ওপেন করছি। আমাদের আগে খেলনা আমদানির প্রয়োজন নেই, কারণ আমাদের সার দরকার, তেল দরকার। তবে আমাদের ভালো দিক হলো এক্সপোর্ট বাড়ছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে।
তিনি বলেন, ব্যাংক খাতের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বেড়েছে। এখন আমানত ও রেমিট্যান্স বাড়ছে। রেমিট্যান্সে ডলারের দাম ৮৭ টাকা থেকে ১০৮ টাকা হয়েছে। আমাদের তারল্য সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছিল তবে এখন অতিরিক্ত তরল্য রয়েছে। পুরো ব্যাংক খাতে এখন অতিরিক্ত ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা তারল্য রয়েছে।
খেলাপি ঋণ মোকাবিলার পর্যায়ে নেই বাংলাদেশ ব্যাংক : দেশের ব্যাংকাররা কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি ঋণ মোকাবিলা করার মতো পর্যায়ে নেই বলে মন্তব্য করেছেন ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এবিবির চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর ধরে খেলাপি ঋণ বড় চ্যালেঞ্জ। সবার প্রচেষ্টা ছাড়ার ঋণখেলাপি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এজন্য ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ও সংস্কার খুবই প্রয়োজন।’ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দুয়েকটি ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকের পেমেন্ট আটকে নাই। অপরের প্রশ্ন জবাবে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রব্যমূল্য অনেক কমেছে। তারপরও আমাদের দেশে দাম বেশি। এর কারণ টাকা, না অন্য মেকানিজম তা গবেষণা করা দরকার। ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি বলেন, বর্তমানে কয়টা গ্রাহক বলতে পারবে ব্যাংক ঋণ দেয় না। ব্যাংকে ঋণের চাপ কমে গেছে। কারণ, অনেক ব্যবসায়ী এ মুহূর্তে প্রজেক্ট করতে চাচ্ছেন না। আবার কোনো গ্রাহক ব্যাংকে এসে টাকা চেয়ে পায় না তাও না। গ্রাহকরা ব্যাংকের টাকা না পেলে বলতাম ব্যাংকের সমস্যা।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী।