শূন্য রিটার্নেও ন্যূনতম কর না দিলে মিলবে না ৩৮ সেবা
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে কর আদায় বাড়াতে ন্যূনতম কর নির্ধারণ করা হতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তি শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দিলে স্লিপ বা প্রাপ্তিস্বীকারপত্র পেতে তাকে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর দেয়া বাধ্যতামূলক করা হতে পারে। তবে কারো আয় ব্যক্তিশ্রেণির করদাতার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করলে তাকে নির্ধারিত হারে আয়কর দিতে হবে। ন্যূনতম কর নির্ধারণ সংক্রান্ত এমন বিধান থাকতে পারে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। এক্ষেত্রে শূন্য রিটার্ন জমা দিলেও ২ হাজার টাকা আয়কর দেয়ার বিধান রাখার প্রস্তাব করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। রিটার্ন জমার স্লিপ না নিলে ৩৮ ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা পাওয়া যাবে না। এমনকি ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকে শূন্য রিটার্ন জমা (করযোগ্য আয় না দেখিয়ে রিটার্ন জমা) দিলেও ২ হাজার টাকা আয়কর দেয়ার বিধান থাকতে পারে। কর আদায় বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। রাজস্ব বোর্ড সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বর্তমানে ব্যক্তি শ্রেণিতে পুরুষ করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা। নারী বা ৬৫ বছর বয়সি পুরুষ করদাতাদের জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতাদের জন্য সাড়ে ৪ লাখ টাকা ও মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহতদের জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করমুক্ত আয়সীমা।
রাজস্ব কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশে বর্তমানে মাত্র ৩২ লাখ মানুষ আয়কর রিটার্ন জমা দেন। তার মধ্যে ৮ লাখেরই নেই করযোগ্য আয়। অন্যদিকে ব্যক্তিশ্রেণিতে টিআইএন ধারীর সংখ্যা মাত্র ৮৬ লাখ। এছাড়া দেশের কর জিডিপি ৭ দশমিক ৮, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তথবিল আইএমএফের শর্ত পূরণে কর জিডিপি ও কর জাল বাড়ানোর শর্ত রয়েছে। এসব বিবেচনায় করযোগ্য আয় নেই- এমন ব্যক্তিদের ওপরও ন্যূনতম ২ হাজার টাকা কর নির্ধারণের প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা জানান, ন্যূনতম কর নির্ধারণ করা হলে অতিরিক্তি প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে। কর প্রদানের সংস্কৃতিতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর না দেয়ার যে মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা আমাদের রয়েছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসবেন করাদাতারা।
আগামী বাজেটে টিআইএন নিবন্ধন বাতিল করার বিধানও অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। কোনো টিআইএনধারী মারা গেলে বা করযোগ্য আয় না থাকলে তার টিআইএন নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিতের বিধান সংযুক্ত হতে পারে।
বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমার নিচে আয় থাকলে করদাতা শুধু শূন্য আয় দেখিয়ে রিটার্ন জমা দিতে পারেন। এক্ষেত্রে তাকে কোনো কর দিতে হয় না। তবে বার্ষিক আয় করসীমার ১ টাকা বেশি হলেও তাকে ন্যূনতম আয়কর দিতে হয়। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার ৫ হাজার টাকা। অন্য সিটি করপোরেশন এলাকার করদাতার ন্যূনতম করের হার ৪ হাজার টাকা। সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্য এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম করের হার ৩ হাজার টাকা।
ধরা যাক একজন চাকরিজীবীর করযোগ্য আয় নেই। তবে তার ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা আছে। ২ বছর আগে ব্যাংকে টিআইএন দিয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেছিলেন। চলতি অর্থবছরে টিআইএনের পরিবর্তে ব্যাংকে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। স্লিপ না দিলে সঞ্চয়পত্রের সুদ আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটার বিধান রয়েছে। আর স্লিপ জমা দিলে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়। বাড়তি উৎসে কর কাটার হাত থেকে বাঁচতে চলতি অর্থবছরে তিনি শূন্য রিটার্ন জমা দিয়ে রিটার্ন জমার স্লিপ নিয়েছেন। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে শূন্য রিটার্ন জমা দিলেও স্লিপ পেতে হলে ২ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে।
রাজস্ব বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে রিটার্ন জমার স্লিপ বাধ্যতামূলক হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে- ৫ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকঋণ নেয়া, কাজী সনদ গ্রহণ করতে, বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য পেতে, ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র ও বিএসটিআইয়ের সনদ পেতে, বাণিজ্যিক ও শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাস সংযোগ অথবা সিটি করপোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ পেতে, কোম্পানি পরিচালক পদ পেতে, আমদানি-রপ্তানি সনদ, ব্যবসা শুরুর ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়নকালে, সমবায় সমিতির লাইসেন্স নিতে, বিমা কোম্পানির সার্ভেয়ার হিসেবে নিবন্ধন পেতে, ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রিকালে, ক্রেডিট কার্ড নিতে, পেশাজীবী সংগঠনের (চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, সার্ভেয়ার) সদস্যপদ পেতে, নৌযানের সার্ভে সনদ নিতে, ইটভাটা চালু করতে, বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে।
এছাড়া কোম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পেতে, আগ্নেয়াস্ত্র সনদ পেতে, আমদানির এলসি খুলতে, ৫ লাখ টাকার বেশি ডাকঘর সঞ্চয়পত্র ও ৫ লাখ টাকার বেশি অন্য সঞ্চয়পত্র কিনতে, ব্যাংক হিসাব খুলতে, উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে, যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসায়িক অংশীদার হলে, বিমা কোম্পানির এজেন্সি সনদ নবায়ন করতে, মোটরসাইকেল ও সিএনজি ছাড়া অন্য যানবাহনের মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নকালে, বিদেশি অনুদান গ্রহণকারী এনজিও বা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সনদ গ্রহণ করতে, আমদানি-রপ্তানি পণ্যের বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে, অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ করতে, বাড়ির নকশা অনুমোদন করতে চাইলে, সরকারি-বেসরকারি দরপত্র জমা দিতে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা গ্রহণকালে, ১৬ হাজার টাকার বেশি মূল বেতনভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন তুলতে রিটার্ন জমার স্লিপ লাগবে।
যদিও রিটার্ন জমা দিলে স্লিপ বা প্রাপ্তিস্বীকার দিতে রাজস্ব বোর্ড বাধ্য। এক্ষেত্রে টাকা নেয়ার রেওয়াজ করলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, কেউ যদি রিটার্ন জমা দিয়ে থাকেন, তাহলে স্লিপ বা প্রাপ্তিস্বীকারপত্র পাওয়ার অধিকার তার আছে। রিটার্ন জমাদানকারী প্রাপ্তিস্বীকারপত্র নিতে চাইলে এটা দিতে সরকার বাধ্য। এজন্য আলাদা করে টাকা দেয়া উচিত নয়।
এই প্রমাণপত্র নিতে অনিয়ম বা ঘুস প্রদানের সংস্কৃতি তৈরি হতে পারে ইঙ্গিত দিয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা না করে রিটার্ন জমা দেয়ার তথ্য একটি ওয়েবসাইটে রাখা যেতে পারে। সরকারি ওয়েবসাইট হবে এবং সরকারিভাবেই এ তথ্য থাকবে। এতে প্রয়োজনে ব্যক্তির টিআইএন নম্বর এবং এনআইডি নম্বর যাচাই করা যাবে। যেকোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানই সেটা দেখে নিতে পারবে। কাগজ তো বানিয়েও নেয়া যায়। ওয়েবসাইটে থাকলে কোনো সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করার দরকার হবে না।