সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আরো বাড়ছে
প্রকাশ : ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যাংক ঋণ নির্ভরতা আরো বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে ২৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ নেবে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। আসন্ন বাজেটের ঘাটতি পূরণে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ নেবে বলে লক্ষ্য ঠিক করছে সরকার। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) যা ছিল ৭৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।
আজ জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র হচ্ছে, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে তার প্রভাব পড়ে মূল্যস্ফীতিতে। কারণ ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ সরকার টাকা ছাপিয়ে মেটায়। টাকা ছাপালে তখন বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যায় এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে হলে সরকারের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কমাতে হবে। উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে টাকা তো নেবেই। তারা টাকা নিয়ে দেশের উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করলে মূল্যস্ফীতি এমনিতেই কমে আসবে। এজন্য দেশে মূল্যস্ফীতি কমানোর অন্যান্য উদ্যোগের চেয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ কম নেয়াই হবে উৎকৃষ্ঠ উদ্যোগ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা ঠিক যে বেশি ব্যাংক ঋণ মানেই বেশি টাকা ছাপানো। আর বেশি টাকা ছাপানো মানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। শুধু তাই নয়, এতে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মসংস্থান ব্যবস্থা।
আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। বিশাল বড় এই বাজেটের ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। আর অনুদান ছাড়া ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেটের আয়-ব্যয়ের বিশাল ঘাটতি পূরণে প্রধান ভরসাস্থল হিসেবে ব্যাংক খাতকে বেছে নিয়েছে সরকার। ফলে এবারও ঘাটতি পূরণে ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা নেয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার।
আসন্ন বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কর-বহির্ভূত ও অন্যান্য আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ২০ হাজার কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। আর বৈদেশিক অনুদান থেকে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। বাজেটে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে (অনুদান ছাড়া) ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। অনুদানসহ এ ঘাটতি দাঁড়ায় ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা। বিশাল এই ঘাটতি পূরণে কোন খাত থেকে কত টাকা ঋণ নেয়া হবে, তারও একটি ছক তৈরি করেছে সরকার।
সে অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ঋণ নেবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া বৈদেশিক ঋণ হিসেবে নেবে ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা আছে ৯৫ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক খাত থেকে সবচেয়ে বেশি ঋণ নিতে চায় সরকার। যার পরিমাণ ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এরপর সঞ্চয়পত্র থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা ও অন্যান্য খাত থেকে ৫ হাজার ১ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে সরকার। ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হচ্ছে, পুরো অর্থবছরে তা নেয়া হলে মূল্যস্ফীতির ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ, টাকাগুলো উৎপাদনমুখী কাজে ব্যবহার করাই সরকারের উদ্দেশ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য বলেছে, চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৬৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আগের অর্থবছরে ঋণ নেয়া হয়েছিল ৩১ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। গত ১ জুলাই থেকে ১০ মে পর্যন্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ১০ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। ফলে ব্যাংকিং উৎস থেকে সরকারের সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭৮ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রায় তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।