কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ হাজার ৩৫২টি সন্দেহজনক লেনদন শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিদর্শনে বিষয়টি উঠে এসেছে। কারণ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সের অন্তরালে বাড়ছে অর্থ পাচার- এমন শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এটি নিশ্চিত করতে গ্রাহকের আড়াই কোটির বেশি নগদ লেনদেন (সিটিআর) তল্লাশি করতে হয়। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচারের সন্দেহে ৫ হাজার ৭৬৬ মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এজেন্টের তথ্য দেয়া হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এ বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। আর প্রাথমিকভাবে হুন্ডির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে ফ্রিজ করা হয়েছে ৬ হাজার ৯৬৭টি মোবাইল ব্যাংক হিসাব। অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) ও সন্ত্রাসীকার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধ-সংক্রান্ত এসব কার্যক্রম। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, উল্লিখিত সন্দেজনক লেনদেনের মধ্যে পৃথকভাবে ৪০টির প্রয়োজনীয় তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এগুলোর আরো অধিকতর তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে সংস্থাটি। এছাড়া অনলাইন গেম, বেটিং ও অবৈধ ফরেক্স ট্রেডিং পরিচালনাকারী ৪৯৭টি ওয়েবসাইট, ২১২টি ফেসবুক পেজ ও ১২০টি মোবাইল অ্যাপস শনাক্ত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা বলা হয়েছে। অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসীকার্যে অর্থায়নের তথ্যাদি চেয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের ৫২ দেশে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের কাছেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে ১৫টি দেশ অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সন্দেহজনক লেনদেনগুলোর ব্যাপারে ধারণা করা হচ্ছে অর্থ পাচার ছাড়াও সন্দেহজনক আরো ২৭টি ক্যাটাগরির অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। তবে বিস্তারিত তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্টভাবে যেসব লেনদেনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ মিলবে সেসব লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে এ রকম নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলোকে। জানা গেছে, এর আগের অর্থবছর (২০২১-২২) একই সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩১২টি। ওই বছর ২ কোটি ৩২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৫টি নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউতে আসে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৬টি লেনদেন তল্লাশি করা হয়। ওই অর্থবছরে সন্দেহজনক হিসাবে ৫ হাজার ২৮০টি লেনদেন শনাক্ত হয়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৭৫ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়ে ৩ হাজার ৫৭৩টি।
এদিকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সর্বশেষ কৌশলপত্রে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে- এমন ১০টি দেশ বা অঞ্চলের নাম দেয়া হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। আর অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরো বেশি হবে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ধারা ২-এর(য) উপধারায় সন্দেহজনক লেনদেন বলতে বোঝায় ‘যাহা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হইতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হইতে অর্জিত সম্পদ বা কোনো সন্ত্রাসী কার্যে, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন। ব্যাংকিং নিয়মে একজন গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট দিনে তার অ্যাকাউন্টে একাধিক বা একটি লেনদেনের মাধ্যমে দশ লাখ টাকা বা তারও বেশি জমা বা উত্তোলন করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে সিটিআর রিপোর্ট করে ব্যাংক। সারা মাসে এ ধরনের লেনদেন তালিকাভুক্ত করে একটি নির্দিষ্ট তারিখে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে। কিন্তু কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যাংকের শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট করে। পরে প্রধান কার্যালয় থেকে সেটি বিএফআইইইতে পাঠানো করা হয়। কারণ এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেনকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সন্দেহ হিসাবে দেখে।