কৃষিতে বিশ্বের শীর্ষ দশে বাংলাদেশ
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রকাশিত প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আরিয়ান স্ট্যালিন
আয়তনে ছোট এবং বেশ ঘনবসতিপূর্ণও। এমন একটি দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৫২ বছরে সীমিত সাধ্য নিয়েই অন্তত ২২টি ক্ষেত্রে বিশ্বের দরবারে গৌরবোজ্জ্বল ও ঈর্ষণীয় অবস্থান তৈরি করেছে। এসব খাতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। বাকিগুলো কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে। এমন অবস্থান তৈরি করতে বাংলাদেশের সরকারগুলোর নীতি-সিদ্ধান্ত যেমন ভূমিকা রেখেছে, তেমনি উদ্যমী সাধারণ মানুষের অবদানও কম নয়। আবার উদ্যোক্তারা শত বিপত্তির মুখেও ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পকারখানা স্থাপনের মাধ্যমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন বেসরকারি খাতনির্ভর অর্থনীতি। এভাবে সবার অবদানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে উত্থান ঘটেছে, তা আজ চোখ বড় করে দেখছে বিশ্ববাসী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের মতো বড় দেশের পরেই উচ্চারিত হয় বাংলাদেশের নাম। কয়েকটি ক্ষেত্রে তো চীন-ভারতকে পেছনে ফেলে প্রথম অবস্থানে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের বড় আয়তনের দেশগুলোকে পেছনে ফেলে ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনের তালিকায় শীর্ষ দশে অবস্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত একই প্রতিবেদনে শীর্ষ দশেও ছিল বাংলাদেশের ১৭টি পণ্য। বিষয়টিকে সুখবর বলছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। তবে এ ধারা অব্যাহত রাখতে কৃষকদের ভর্তুকি এবং পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের ওপর জোর দেয়ার পরামর্শ তাদের। করোনা মহামারির রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যা সারা বিশ্বের খাদ্য শৃঙ্খলেই ফেলেছে নেতিবাচক প্রভাব। তবে এমন অবস্থাতেও থেমে থাকেননি দেশের কৃষকরা। ভয়-ডর উপেক্ষা করেই ছুটে গেছেন ফসলের মাঠে। ফলিয়েছেন সোনার ফসল। তাদের এ হাড়ভাঙা শ্রমের কারণেই কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের বড় দেশগুলোকে পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। আয়তনে ছোট হলেও জায়গা করে নিয়েছে সেরা দশে। এ তথ্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ফাওর। চাল, পেঁয়াজ, মরিচ, কুমড়া, ফুলকপি, ব্রোকলিসহ ২২টি খাদ্যপণ্যের তালিকা প্রকাশ করে সংগঠনটি দেখিয়েছে এ খাতের অগ্রগতির তুলনামূলক চিত্র। এফএওর বাংলাদেশ প্রতিনিধি রবার্ট ডি সিমসন বলেন, পুষ্টি, নিরাপত্তা, মান নিয়ন্ত্রণ এবং ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির বিষয়টি মাথায় রেখেই এ প্রতিবেদন তৈরি করে এফএও। পাশাপাশি প্রতিটি দেশের প্রধান ফসল চিহ্নিত করাও এর লক্ষ্য। বাংলাদেশ এ খাতে অনেক ভালো করেছে। তবে আরো বেশি উন্নতির জন্য কাজ করতে হবে। অবস্থান নির্ধারণী এ প্রতিবেদনকে সুখবর হিসেবে দেখছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। তবে একে টেকসই করতে উৎপাদন আরো বাড়ানো এবং কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির দিকে আরো বেশি নজর দেয়ার পরামর্শ তাদের। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, জনবহুল এ দেশে যত বেশি ফসল উৎপাদন হয়, তত আমাদের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন আরো বাড়াতে হবে। এজন্য কৃষদের আরো বেশি সহায়তা দিতে হবে। তারা যাতে ন্যায্যমূল্য পায়, সেটার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরের প্রায় সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতেই হিমশিম খেতে হয়েছে দেশকে। তখন আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হতো। দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়তে হয়। এখন দেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি। আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। তার পরও বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ এখন চাল, সবজি ও মাছ রপ্তানিকারক দেশ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী খাদ্যশস্য, ধান, গম, সবজি, মাছ, আলু, আম, পাট, গরু-ছাগল উৎপাদনে এখন বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে। নতুন ও প্রতিকূল পরিবেশ-সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনেও বিশ্বের শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমতে থাকাসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, সবজি উৎপাদনে তৃতীয় আর মাছ ও ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ অবস্থানে। আলু উৎপাদনে সপ্তম, আম উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্সিং) উন্মোচনের পর পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা তোষা ও দেশি পাটের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেন। পাটের ছত্রাক রোগ-প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন করেছে। পাট বাংলাদেশের হিসেবে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব স্বীকৃতি পেয়েছে। এফএও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি বিপ্লবে বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। বর্তমান সরকারের মেয়াদে সারের দাম কমানো হয়। ১০ টাকার বিনিময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা, সেচের পানির ভর্তুকির টাকা সরাসরি কৃষকের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা এবং সেই সঙ্গে কৃষকের মাঝে উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপের ফলে কৃষিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে ১০ গুণ। সরকারের যুগোপযোগী পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই এ সাফল্য। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে দুই টন চাল উৎপাদিত হতো। এখন হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে চার টনেরও বেশি। ধান ধরে হিসাব করলে তা ছয় টন। তাছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বে গড় পাঁচ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ছয় দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে। সরকার কৃষকদের সম্ভাব্য সব রকম উপকরণ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকারের প্রবর্তিত কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেশে ও বিদেশে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। দেশের ৩৫ জেলায় ২৫ শতাংশ ভর্তুকিতে হালচাষের জন্য ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হারভেস্টারসহ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রমের আওতায় বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। আমন, আউশ ও বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনে বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদনের রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। দেশে রীতিমতো সবজি বিপ্লব ঘটে গেছে গত এক যুগে। এক সময় ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, এখন তা বাস্তব। মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঈর্ষণীয়। বিশ্বে মোট আম উৎপাদনে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। আলু উৎপাদন এক কোটি টন ছাড়িয়েছে। এ সাফল্য বাংলাদেশকে এনে দিয়েছে আলু উৎপাদনকারী শীর্ষ ১০ দেশের কাতারে। ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের সফলতাও বাড়ছে। ১৯৭০ সাল থেকে দেশি জাতকে উন্নত করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা উচ্চফলনশীল (উফশি) জাত উদ্ভাবনের পথে যাত্রা করেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ৬৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) করেছে ১৪টি ধানের জাত। আর ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) ৪১৭টি কমোডিটি ভ্যারাইটি অবমুক্ত করেছে। এর মধ্যে খাদ্যশস্য ৩৫, তেলজাতীয় ফসল ৪৩, ডালজাতীয় ফসল ৩১, টিউবার ৭৮, সবজি ৮৯, ফল ৬৪, ফুল ১৬, মশলা ২৪, ফাইবার ৬ এবং নারকোটিক জাতীয় একটি জাত রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) এ পর্যন্ত ২৬টি জাত অবমুক্ত করেছে। ব্রি ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা সংস্থা-বিনার বিজ্ঞানীরা মোট ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। গত বছর বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করে বাংলাদেশের কৃষি গবেষকরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ।