ডলারের বিকল্প মুদ্রায় ঝুঁকছে বাংলাদেশ

ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন জুলাই থেকে

প্রকাশ : ২৫ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুদ্রা মার্কিন ডলার। ১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে ডলার তার প্রভাবশালী রিজার্ভ স্ট্যাটাস অর্জন করে। তখন থেকেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ ও লেনদেনে একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রেখেছে মার্কিন ডলার। শক্তিশালী মুদ্রা হওয়ায় বিশ্বের অনেক দেশই এটিকে ‘রিজার্ভ মুদ্রা’ হিসেবে বেছে নিয়েছে। তবে এখন পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করতে বিকল্প মুদ্রা তৈরির চেষ্টা দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে চীন ও রাশিয়া কয়েক বছর ধরেই কাজ করে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোও রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের আধিপত্য রুখতে এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রূপ নিতে পারে। এরই মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে ডলারের বিকল্প হিসেবে রুবল দিয়ে লেনদেন করছে রাশিয়া। একইসঙ্গে চীনের ইউয়ান দিয়েও সংঘটিত হচ্ছে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যিক লেনদেন। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতও আমিরাতের দিরহাম, চীনের ইউয়ান, হকংয়ের ডলার দিয়ে রাশিয়া থেকে জ্বালানি কিনছে। এরফলে যুক্তরাষ্ট্র যতটা ভেবেছিল ততটা প্রভাব পড়েনি রাশিয়ার ওপর। বরং নিষেধাজ্ঞায় উল্টো ফুলে ফেপে উঠেছে রুশ মুদ্রার মান। এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ কমে যাওয়া ঠেকানোর পাশাপাশি ডলারের সংকট সামাল দিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের কথা ভাবছে বাংলাদেশ সরকার। এর আগে গত এপ্রিলে ইসরাইল প্রথমবারের মতো দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে চীনা মুদ্রা ‘রেনমিনবি’ যোগ করেছে। দেশটি নতুন কৌশল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার ও জাপানিজ ইয়েনের রিজার্ভ বাড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ডেভিড লেডলার বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডলারের স্ট্যাটাস তথা মর্যাদা থেকে একটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক সুবিধা পায়। যখন অন্য দেশগুলো তাদের ডলারের হোল্ডিং বাড়ায়, তখন লেনদেনের স্ট্রিংয়ে জড়িত চূড়ান্ত পণ্য হলো যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ফেড প্রিন্ট’ কাগজের বিনিময়ে আসল পণ্য ও পরিষেবা পায়।’ মার্কিন ডলার এখনো প্রভাবশালী হলেও এ ক্ষেত্রে কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, যা এ মুদ্রার আধিপত্যের জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন দেশের বৈদেশিক রিজার্ভের ক্ষেত্রে শক্তিশালী চারটি মুদ্রা প্রাধান্য পেয়ে আসছে। এসব মুদ্রা হচ্ছে মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, জাপানি ইয়েন ও ইউরো। ১৯৯৯ সালে বৈদেশিক রিজার্ভের ৯৮ শতাংশ এ মুদ্রাগুলো থাকলেও ২০২১ সালে তা ৯২ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে নতুন মুদ্রা হিসেবে যোগ দিয়েছে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ডলার। আইএমএফের ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিক হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশের কাছে প্রায় ২২৫.৪৮ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার রয়েছে। এর পাশাপাশি বৈদেশিক রিজার্ভ হিসেবে বিশ্বের দেশগুলোর কাছে ২৮৭ বিলিয়ন কানাডিয়ান ডলার রয়েছে। এদিকে রাশিয়া ও চীনের নিয়ন্ত্রণাধীন ব্রিকস দেশগুলো গত ২৩ জুন চীনের বেইজিংয়ে তাদের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনে নতুন একটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রচলনের পরিকল্পনার কথা জানায়। তাতে বলা হয়, পাঁচটি প্রধান উদীয়মান অর্থনীতির নেতারা আন্তর্জাতিক রিজার্ভ মুদ্রা তৈরির জন্য একমত হয়েছেন।

এবার বাংলাদেশেও বিকল্প লেনদেন শুরু করছে বলে জানা গেছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য রুপিতে শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু হওয়ার কার্যক্রম আগামী মাস, অর্থাৎ জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে উদ্বোধন হতে পারে। তবে রুপিতে বাণিজ্য হলেও মার্কিন ডলারে বাণিজ্য হওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত থাকছে আগের মতোই। কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’। এ ব্যবস্থায় অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ণ ব্যাংককে ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) এবং আইসিআইসিআই ব্যাংকে সম্প্রতি হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হিসাবের নাম নস্ট্র হিসাব। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংককে নস্ট্র হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে। একই হিসাব খুলতে সোনালী ব্যাংক আরবিআইয়ের অনুমতি পেতে পারে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে। আপাতত ভস্ট্র হিসাব খোলার দিকটি বিবেচনায় থাকছে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের একই প্রবণতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলার হচ্ছে অন্যতম প্রধান মুদ্রা। ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এত দিন ডলারেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করে আসছে। ব্যতিক্রমের মধ্যে যেমন চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেন। ভারত অবশ্য ডলারের পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রা রুপিতে অনেক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছে আগেই। তবে দেশটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে শুরু করতে যাচ্ছে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য। ভারতের সঙ্গে রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু হওয়ার কার্যক্রম আগামী মাস অর্থাৎ জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে উদ্বোধন হতে পারে। ঢাকা ও নয়াদিল্লি-উভয় জায়গা থেকে আলাদা করে উদ্বোধনের প্রস্তুতি রয়েছে উভয় দেশের সরকারের। আপাতত বাণিজ্য হবে শুধু ভারতীয় মুদ্রা রুপিতে। তবে মার্কিন ডলারে বাণিজ্য হওয়ার বিষয়টি উন্মুক্ত থাকছে আগের মতোই। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, কার্যক্রমটি উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ ১১ জুলাই। ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করার আলাপ চলছে প্রায় এক দশক ধরে। ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’। এ ব্যবস্থায় অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংককে ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) এবং আইসিআইসিআই ব্যাংকে সম্প্রতি হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ হিসাবের নাম নস্ট্র হিসাব। নস্ট্র হিসাব খোলা নিয়ে চার ব্যাংকের মধ্যে চিঠি চালাচালি এখনো চলছে বলে জানা গেছে। এক দেশের এক ব্যাংক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশে হিসাব খুললে সে হিসাবকে নস্ট্র হিসাব বলা হয়ে থাকে। একইভাবে বিদেশের কোনো ব্যাংক যদি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে একই উদ্দেশে হিসাব খুলে থাকে, তাকে বলা হয় ভস্ট্র হিসাব। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) ইতিমধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংককে নস্ট্র হিসাব খোলার অনুমতি দিয়েছে। একই হিসাব খুলতে সোনালী ব্যাংক আরবিআইয়ের অনুমতি পেতে পারে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে। আপাতত ভস্ট্র হিসাব খোলার দিকটি বিবেচনায় থাকছে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়। রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশি মুদ্রা টাকাও যখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে, তখন ভস্ট্র হিসাব খোলার বিষয়টি আসবে। জানা গেছে, কার্যক্রমটি ঢাকায় উদ্বোধন করবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। আরবিআইয়ের গভর্নর শক্তিকান্ত দাসের পাশাপাশি এসবিআইয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সি এস শেট্টিও জুম প্ল্যাটফর্মে থাকতে পারেন। আবার ভারতের দিক থেকেও আলাদা করে এ কার্যক্রম উদ্বোধনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে। একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের একই প্রবণতা রয়েছে।

অবশ্য ডলারের সঙ্গে রুপির বিনিময় হার কত হবে, সেটা কি বাজারভিত্তিক না নির্ধারিত, তা এখনো ঠিক হয়নি বলে জানা গেছে। কোভিড ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলার-সংকট দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের দিল্লিতে গত বছরের ডিসেম্বরে যখন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়, তখনই ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ও ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর ভারতের বেঙ্গালুরুতে গত ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জি-২০ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরদের সম্মেলনের এক ফাঁকে দুই দেশের গভর্নরদের একটি বৈঠক হয়। উভয় গভর্নরই কাজটি দ্রুত করার বিষয়ে একমত হন বলে জানা গেছে। বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত মুদ্রা নয় ভারতীয় রুপি। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের বাণিজ্যঘাটতি। ফলে রুপিতে লেনদেনে বাংলাদেশ কোনো ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে কি না-এমন প্রশ্নও রয়েছে। প্রক্রিয়াটি শুরু হলে পণ্য বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ১৯ জুন মুদ্রানীতি প্রকাশের সময় বলেই দিয়েছেন, টাকার পাশাপাশি রুপিতে ব্যবহার করা যাবে, পে কার্ড নামে এমন একটি ডেবিট কার্ড নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশিরা ভারতে ঘুরতে গিয়ে এ কার্ড দিয়ে লেনদেন করবেন এবং কার্ডটি চালু হলে বাংলাদেশিদের ডলার খরচ কমবে। গভর্নরের মতে, কেউ ভারতে গেলে ভ্রমণকারীর ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে, সে পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন।