বিশ্বব্যাংকের হিসেবে রেমিট্যান্স উপার্জনে বিশ্বে অষ্টম অবস্থানে বাংলাদেশ। অবশ্য ২০২১ সালে যেখানে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২২ বিলিয়ন ইউএস ডলার, গত বছর তা নেমে এসেছে ২১ বিলিয়ন ইউএস ডলারে। এর কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অনানুষ্ঠানিক উপায়ে অর্থ আসা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের একটা বড় উৎস হলো রেমিট্যান্স, যার বড় একটা অংশ আসে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। এছাড়া প্রবাসী আয় থেকে যোগ হয় দেশের মোট জিডিপির ৪.৬ শতাংশ। রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়-বিশ্বজুড়েই অর্থনীতিতে রেখে চলেছে বড় ভূমিকা। আর সেই ভূমিকার কথা মাথায় রেখেই জাতিসংঘ প্রতি বছর ১৬ জুন পালন করে আন্তর্জাতিক পারিবারিক রেমিট্যান্স দিবস। সংস্থাটির হিসেবে বিশ্বজুড়ে ২০০ মিলিয়ন প্রবাসী তাদের পরিবারের প্রায় ৮০০ মিলিয়ন সদস্যের কাছে রেমিট্যান্স পাঠায়। সাধারণত একজন প্রবাসী তার আয় করা অর্থ যখন তার পরিবারের সহায়তার জন্য দেশে পাঠায় সেটাকে রেমিট্যান্স বলে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটাকে বলা হয় লাইফলাইন’। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইএমওর হিসেবে বিশ্ব জনসংখ্যার ৩.৪ শতাংশ অভিবাসী। আর তাদের উপার্জিত অর্থ পুরো বিশ্বের জিডিপিতে ৯.৪ শতাংশ অবদান রাখে। সংস্থাটি বলেছে, সবমিলে বিশ্বের ১৪ শতাংশ মানুষ রেমিট্যান্সের সাথে যুক্ত, যাদের কেউ পাঠাচ্ছে আবার কেউ গ্রহণ করছে। তবে বিশ্বব্যাংকের হিসেবে মোট রেমিট্যান্সের ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ সাধারণত যায় নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। অর্থাৎ, ৪০টি ধনী দেশে কাজ করে শ্রমিকরা অন্তত ১২৫টি দেশে তাদের পরিবার ও স্বজনের কাছে রেমিট্যান্স পাঠায়, যা দিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হয়। ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে পাঠানো রেমিট্যান্সের মোট পরিমাণ ৭৯৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার। আর এর মধ্যে ৬২৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার গিয়েছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। ২০২১ সালে এর পরিমাণ ছিল ৫৯৭ বিলিয়ন ইউএস ডলার। তবে সে বছর রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০.২ শতাংশ, যা গত বছর কমে দাঁড়ায় ৪.৯ শতাংশ। চলতি জুন মাসের ২৩ দিনে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ সময়ে ১৭৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা। এর আগে গত মে মাসে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার। সেই তুলনায় চলতি জুনে ১০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সাধারণত ঈদের আগে বিপুল পরিমাণ প্রবাসী আয় বাংলাদেশে আসে। এ সময় প্রবাসীরা পরিবারের সদস্যদের ঈদের বাড়তি খরচ জোগাতে বেশি পরিমাণ আয় দেশে পাঠান। তবে এর আগে পবিত্র ঈদুল ফিতরের মাস এপ্রিলেও প্রবাসী আয় খুব বেশি আসেনি। সাম্প্রতিক মাসগুলোয় প্রবাসী আয়ের গতি শ্লথ হয়েছে। তবে জুন মাসের পূর্ণাঙ্গ হিসাব না আসা পর্যন্ত বোঝা যাবে না যে, গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রবাসী আয় শেষ পর্যন্ত বেশি হলো কি না। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুন মাসে দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৮৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার। দেশে এখনো ডলার সংকট চলছে। এর মধ্যে গত মে মাসে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে যায়। ওই মাসে প্রবাসী আয় আসে ১৬৯ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ কম।
যে কারণে বাড়ল রেমিট্যান্স
অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও দেশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রধানত চার কারণে বাড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি রেকর্ড পরিমাণে বাড়ছে। টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে প্রবাসীরা বাড়তি অর্থ পাচ্ছেন। হুন্ডির পরিবর্তে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দ্রুত গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে রেমিট্যান্সের অর্থ। এছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে রেমিট্যান্সের অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর আরোপিত ফি প্রত্যাহার করায় খরচ কিছুটা কমেছে। এতেও রেমিট্যান্স বাড়বে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছরে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ বাড়তে পারে। ফলে বছর শেষে তা ২ হাজার ৩০০ কোটি ডলারে দাঁড়াতে পারে। সূত্র জানায়, করোনার কারণে ২০২০ সালে জনশক্তি রপ্তানিতে মন্দা ছিল। ওই সময়ে বিদেশে যাওয়ার পরিবর্তে মানুষ ফেরত এসেছে বেশি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থমকে ছিল জনশক্তি রপ্তানি। ওই বছরের অক্টোবর থেকে তা বাড়তে থাকে। ২০২১ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরে জনশক্তি রপ্তানি হয়েছিল ৭৪ হাজার জন। ওই বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ লাখে। ২০২২ সালের জানুয়ারি-মার্চে ৩ লাখ ২৩ হাজার জন, একই বছরের এপ্রিল-জুনে ২ লাখ ৯৩ হাজার, জুলাই-সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৫৯ হাজার এবং অক্টোবর-ডিসেম্বরে ২ লাখ ৬১ হাজার জন জনশক্তি রপ্তানি হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চে ৩ লাখ ২৩ হাজার জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে রেকর্ড হয়, সব মিলে এখন বিদেশে মোট কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৩৫ লাখ। নতুন অভিবাসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। দেশগুলো মন্দা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। নতুন কর্মীরা দেশে অর্থ পাঠানো শুরু করলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়বে বলে মনে করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক বছর ধরে হুন্ডির বিরুদ্ধে সরকার বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রবাসীদেরও সচেতন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সরকারের একাধিক প্রতিনিধিদল গিয়ে সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। গত বছরের জানুয়ারি-মার্চে সে দেশ থেকে রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫ কোটি ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে তা প্রায় শতভাগ বেড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ৮৭ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের ডলারের দাম গত বছরের ডিসেম্বর থেকে গত জুন পর্যন্ত প্রতি মাসেই গড়ে এক টাকা করে বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে রেমিট্যান্সের প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে সরকারি খাতের আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ প্রতি ডলারে মিলছে ১১১ টাকা ২৫ পয়সা। কোনো কোনো ব্যাংক আরো বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনছে। এছাড়া পুরস্কারসহ অন্যান্য প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। তবে হুন্ডিতে ডলারের দাম এর চেয়ে বেশি। তবে এতে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় ২৮ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে রেমিট্যান্সের বিপরীতে বেশি অর্থ পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। এর মধ্যে যেসব প্রবাসীর বিদেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, তাদের হিসাব খুলতে সহায়তা করা হচ্ছে। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ব্যাংকিং সেবা বাড়ানো হচ্ছে। দেশে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে বিধিবিধান শিথিল করা হয়েছে। এখন যে কেউ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই যে কোনো অঙ্কের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাতে পারেন। এই অর্থ প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতে ব্যাংক কোনো ফি নিচ্ছে না। এখন মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপসের মাধ্যমেও রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব কারণে আগামী অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার আভাস দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।