নতুন কেনার চেয়ে ভাঙছে বেশি

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ খরা

প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে বর্তমানে অনেকেই জমানো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। অন্যদিকে তাদের পক্ষে নতুন করে সঞ্চয় করার প্রবণতাও কমে গেছে। ফলে তাদের মধ্যে নতুন সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের ফলেও এ খাতে বিনিয়োগ অস্বাভাবিক হারে কমছে। সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগের চেয়ে ভাঙানোর প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। তবে একক মাস হিসাবে মে মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ বেড়েছে। জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এমন ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা বা ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বেশি ছিল। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে সঞ্চয়পত্রে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৪ হাজার ৭১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। একই সময়ে মূল পরিশোধ বা ভাঙানোর পরিমাণ ৭৭ হাজার ৭৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ ৩ হাজার ২৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা বেশি, যা এর আগে ১০ মাস শেষে ছিল ৩ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। যা সঞ্চয়পত্রের নিট বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আর একই সময়ে সঞ্চয়পত্রে সরকারকে সুদ বাবদ ৪১ হাজার ৭৮৯ কোটি ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের শুরু থেকেই সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেলেও অর্থবছরের ১১তম মাসে নিট বিনিয়োগ বেড়েছে। একক মাস হিসেবে মে মাসে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৬ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। একই সময়ে মোট জমার পরিমাণ ৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। সেই হিসাবে মে মাসে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৫১ কোটি টাকা। একই সময়ে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৩ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। মে মাসে বিনিয়োগ বাড়ার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বাজেটের আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশকিছু সুবিধা দেওয়া হবে- গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন খবরে সঞ্চয়কারীরা বেশি বিনিয়োগ করেছেন। জানা গেছে, আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে। সরকার তা বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজে লাগায়। এ কারণে অর্থনীতির ভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসাবে গণ্য করা হয়। সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ কমায় স্বস্তিতে রয়েছে সরকার। কেননা, এই খাতে সরকারকে অনেক বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়, যা বর্তমানে অনেক কমে গেছে। জানা গেছে, ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের হার কম এবং পুঁজিবাজারে দীর্ঘ মন্দার কারণে বেশ কয়েক বছর ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেশি পরিমাণে বাড়ছিল। এতে সরকারের সুদ পরিশোধের ব্যয়ও অনেক বেশি বেড়ে যায়। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফা বা সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ছে। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বিভিন্ন কড়াকড়ি আরোপ করে আসছে সরকার। সরকারের বিভিন্ন শর্তের মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্রে ৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে আয়কর রিটার্ন সনদ বাধ্যতামূলক করা, ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ২ শতাংশ কমানো, সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ সীমা কমিয়ে আনা, মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা। এ ছাড়া দুর্নীতি কিংবা কালো টাকায় সঞ্চয়পত্র কেনা বন্ধে ক্রেতার তথ্যের একটি ডাটাবেস তৈরি করা হয়েছে। এসব কড়াকড়ির প্রভাবে বর্তমানে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তলানিতে নেমে গেছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কয়েক দফায় সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানোর পরও তা ব্যাংকের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে ব্যাংক আমানতের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের সুদ হারের ব্যবধান আরো কমানোর পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে এই পরামর্শ দিয়েছে তারা। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষযটি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছে আইএমএফকে। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ব্যাংক আমানতের সুদ হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার এখনো অনেক বেশি। এখানে আরো কিছুটা সামঞ্জস্য আনা দরকার। সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিনিয়োগ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় মেয়াদ শেষে নতুন করে অনেকেই আর বিনিয়োগ করতে পারছেন না। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, নানা ধরনের কড়াকড়ি আরোপের কারণে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ধস নেমেছে। তবে বর্তমানে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরাই এ খাতে বিনিয়োগ করছেন। এ ছাড়া সঞ্চয়পত্রকে সামাজিক সুরক্ষার উপকরণ হিসাবে না দেখে আর্থিক উপকরণ হিসাবে বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কড়াকড়ি আরোপ করার কারণেই মূলত সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ খুব বেশি মুনাফা পাচ্ছে না। এটাও সঞ্চয়পত্র কমার বড় একটা কারণ। ঋণের বোঝা কমাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে টিআইএন এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করায় অনেকেই সঞ্চয়পত্রে আগের মতো বিনিয়োগ করতে পারছেন না। তার মতে, আগে কালো টাকাও সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ হতো। এখন সেটা হচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন মানুষ আর সঞ্চয়পত্র কিনছে না। এর তিনটি কারণ রয়েছে- প্রথমত, ৫ লাখ টাকার ওপরে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে আয়কর রিটার্ন দিতে হচ্ছে। কিন্তু নানা রকম ঝামেলার কারণে অনেকেই আয়কর রিটার্ন দিতে চান না। ফলে তারা এখান থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে।

মে মাসে কিছুটা বেড়েছে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি : কমতে থাকা সঞ্চয়পত্রের বিক্রি আবার একটু একটু করে বাড়ছে। মে মাসে যে পরিমাণ সঞ্চয়পত্র ভাঙানো হয়েছে, বিক্রি হয়েছে তার চেয়ে ৫৫১ কোটি টাকা বেশি। আগের মাস এপ্রিলেও ৫৮২ কোটি টাকা বেশি বিক্রি হয়। যদিও সব মিলিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে বিক্রির চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ বেশি রয়েছে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। এর মানে সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণের পরিমাণ কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং সঞ্চয়পত্রে নানা কড়াকড়ির কারণে এমন হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার বিদেশি উৎসের পাশাপাশি ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার একটি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্রে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা ছিল। তবে সংশোধিত বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সঞ্চয়পত্রে আশানুরূপ ঋণ না পাওয়ায় এখন সরকারের ব্যাংক ঋণে নির্ভরতা বাড়ছে। গত মে পর্যন্ত ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে সরকার। মূল বাজেটে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা করা হয়েছে। আর চলতি অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে মোট ৭৪ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আর ভাঙানো হয়েছে ৭৭ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ঋণ কমেছে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা। আন্তঃব্যাংক কলমানি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধারসহ বিভিন্ন উপায়ে অনেক ব্যাংক চাহিদা মেটাচ্ছে। অবশ্য চলতি অর্থবছর সুদহারের নতুন ব্যবস্থার ফলে পরিস্থিতির খানিকটা উন্নতি হতে পারে। ২০১৯ সালে জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করে সরকার। এর পর থেকে নতুন করে সব ধরনের সঞ্চয়পত্র অনলাইনে কিনতে হচ্ছে। তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক তিন বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র এবং পেনশনার সঞ্চয়পত্র স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে বেচাকেনা হচ্ছে। নতুন কেনা সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা নিতে হয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে। তবে নতুন নিয়ম চালুর আগে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কেনা পাঁচ বছর মেয়াদি সর্বশেষ সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ ২০২৪ সালের ২৯ জুন শেষ হবে। আগামী বছরের জুনের পর ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকের সব ধরনের ম্যানুয়াল হিসাবও বন্ধ হয়ে যাবে।