প্রায় প্রতিটি দেশেই কিছু মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য থাকে না। অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোতে এমন মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের সব মানুষ যাতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দ্বিতীয় লক্ষ্য হিসেবে ক্ষুধামুক্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না, এমন মানুষ যেসব দেশে বেশি, সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশে এখন ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য তাঁদের নেই। বাংলাদেশের ওপরে আছে ভারত, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও চীন। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেয়ে পুষ্টিমান অর্জন করতে এটি বড় বাধা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দ্বিতীয় লক্ষ্য ক্ষুধামুক্তিতে (জিরো হাঙ্গার) ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ও পুষ্টিমান অর্জনের কথা বলা হয়েছে। সম্প্রতি এসডিজি অর্জনে ১৭টি লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি কেমন, তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ‘অ্যাটলাস অব সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস ২০২৩’ শিরোনামের এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বিবেচনায় আনলে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, দারিদ্র্য কমেছে। না খেয়ে থাকার প্রবণতা নেই বললেই চলে। কিন্তু গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাতে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ওঠেনি। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের উচ্চমূল্যের কারণে তারা তা কিনতে পারছেন না। সেলিম রায়হান আরও বলেন, প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক নীতি কৌশল পরিবর্তনের সময় এসেছে। কারণ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত খাবার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুষম বণ্টন হওয়া উচিত। বিভিন্ন দেশের কতসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সক্ষমতা নেই, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে সেই চিত্র উঠে এসেছে। এবার দেখা যাক, কোন দেশে কতসংখ্যক মানুষ মানসম্পন্ন খাবার কিনতে পারেন না। ভারতে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না। দেশটির ৯৭ কোটি ৩০ লাখ মানুষ মানসম্পন্ন খাবার পায় না। ভারতেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর এ দশা। দ্বিতীয় স্থানে আছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া। দেশটির প্রায় ১৯ কোটি ৮০ লাখ মানুষ পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবার পায় না। তৃতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ায় ১৮ কোটি ৯০ লাখ, চতুর্থ স্থানে থাকা পাকিস্তানে ১৮ কোটি ৪০ লাখ এবং পঞ্চম স্থানে চীনে প্রায় ১৭ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। এছাড়া ইথিওপিয়ায় প্রায় ১০ কোটি, কঙ্গোতে ৮ কোটি, ফিলিপাইনে সাড়ে সাত কোটি ও মিসরে ৭ কোটি ৪০ লাখ মানুষের এমন দশা। এর বাইরে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে আড়াই কোটি মানুষ এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় এক কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পায় না। উন্নত ধনী দেশেও এ সমস্যা আছে। তবে সেখানে এমন মানুষের সংখ্যা কম। অন্যতম ক্ষমতাধর ও ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও ৪৯ লাখ মানুষ মানসম্পন্ন খাবার কিনতে পারেন না। আর যুক্তরাজ্যে এ সংখ্যা ৩ লাখ। এছাড়া জার্মানির মতো ধনী দেশে এমন মানুষের সংখ্যা ২ লাখ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা বিশ্বের অন্যতম দেশ হলো জাপান। জাপানের ৩১ লাখ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না। বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রায় ৮২ কোটি ৮০ লাখ মানুষ অপুষ্টিতে ভোগে। প্রতি ১০ জনে ১ জন পুষ্টিহীনতায় আছে। এছাড়া সারা বিশ্বের ৩১০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সক্ষমতা নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার চ্যালেঞ্জ আরো বেড়েছে। এসডিজির দ্বিতীয় লক্ষ্য ক্ষুধামুক্তিতে বেশ কিছু লক্ষ্য আছে। যেমন ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবী হবে ক্ষুধামুক্ত। প্রত্যেক নাগরিক পুষ্টিসম্পন্ন খাবার খাবে। এ সময়ের মধ্যে সব ধরনের অপুষ্টি দূর হবে। এছাড়া ২০৩০ সালের মধ্যে কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। আর সব ধরনের কৃষি উৎপাদন টেকসই পদ্ধতিতে হবে। এসডিজি দ্বিতীয় লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য পুষ্টিমানসম্পন্ন সুষম খাবার খেতে হবে, যাতে ওই ব্যক্তি পর্যাপ্ত ক্যালরি পায়। কিন্তু বিশ্বের বহু মানুষ দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত খাবার কিনতে পারেন না। কম খাবার গ্রহণ ও সুষম খাবার না পেয়ে শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে। খর্বকায় হয়ে যাচ্ছে।