অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার

বেপরোয়া সিন্ডিকেট

প্রকাশ : ১২ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

তিন স্তরে ব্যবসায়ীদের যোগসাজশের কারণে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। পণ্যের মূল্য নিয়ে লুকোচুরি করতে পাকা রসিদ, চালান, মেমো কিংবা ইনভয়েস ছাড়াই উৎপাদনকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন। মূল্য নির্ধারণের ফাঁকফোকরে উৎপাদনকারী থেকে খুচরা কারবারি একে অপরের কাছ থেকে দাম বেশি নিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সরাসরি ভোক্তার ওপর। কারণ, দিনশেষে ভোক্তাকে বেশি দাম পরিশোধ করে পণ্যসামগ্রী কিনতে হচ্ছে। এছাড়া সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে চিনি, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। এমনকি, মুদি দোকানে প্রতিদিনের মূল্য তালিকা প্রদর্শন করার বিধান থাকলেও খোদ রাজধানীর বেশিরভাগ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দোকানে সেটি অনুসরণ করা হচ্ছে না। দাম বাড়াতে বিভিন্ন অপতৎপরতা শুরু করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা।

সরকারি প্রতিবেদন : ১৫ টাকার আলু ৫০ টাকায় বিক্রি : বাজারে নতুন আলুর কেজি ৪০০ টাকাও দেখেছে বাংলাদেশ। তবে বছরের মাঝামাঝি সময়ে চাহিদার উদ্বৃত্ত উৎপাদনের পরও ৫০ টাকা সচরাচর হয় না। নতুন মৌসুম আসতে এখনো ঢের বাকি। এরই মধ্যে আলুর দামের এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বিপাকে ভোক্তারা। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের প্রতিবেদন বলছে, হিমাগার ও মজুতদারদের কারসাজিতে বাজারে এ অস্বাভাবিক দাম। কৃষকের হাতে আলু শেষ হওয়ার পর জুন থেকে হিমাগারের আলু বাজারে সরবরাহ আসতে থাকে। কিন্তু এই সরবরাহ ঠিকভাবে হচ্ছে না বলে প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিমভাবে দাম বৃদ্ধি করছে বলেই কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হওয়া ১৫ টাকা কেজি দরের আলু বাজারে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর।

মশারি, কয়েল ও স্প্রের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধির অভিযোগ : দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এ থেকে বাঁচতে মানুষ মশারি, কয়েল, অ্যারোসল স্প্রে ও র‍্যাকেটের মতো মশাবিরোধী পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা এসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। এ বছর দেশে ডেঙ্গু জ্বরে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘৫৭ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে।’ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত সোমবার ডেঙ্গু জ্বরে তিনজন মারা গেছেন। নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৮৯ জন। তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই ঢাকায় আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে আগস্ট-সেপ্টেম্বর ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের মূল সময় হওয়ায় এটি এখনো চরম অবস্থায় পৌঁছায়নি। রাজধানীর মিরপুর, ফার্মগেট ও কলাবাগান এলাকার বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় মশানিরোধক পণ্যের বিক্রি বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ক্রেতাদের অভিযোগ, চাহিদা বাড়ার সুযোগ নিয়ে খুচরা বিক্রেতারা মশারি, কয়েল, স্প্রে ও র‍্যাকেটের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

গমের সংকট নেই, তবু কমছে না আটা-ময়দার দাম : আন্তর্জাতিক বাজারে গমের বুকিং রেট সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এলেও দেশের বাজারে সে অনুযায়ী আটা-ময়দার দাম কমছে না। অথচ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন গম বেশি আমদানি হয়েছে। তারপরও সংকটের আগের দরেই আটা-ময়দা বিক্রি করছে মিলগুলো। গত ৬ মাসের বেশি সময় ধরে বিরতিহীনভাবে গমের এই সরবরাহ চলছে। অথচ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশের বাজারে গম সংকটের অজুহাত দেখিয়ে আসছেন আটা-ময়দার মিল মালিকেরা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই ৪৪ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানি হয়েছে। অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে গম আমদানি হয়েছিল মাত্র ৩৪ লাখ ৭৯ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় এই অর্থবছরেই ৯ লাখ ৮৯ হাজার মেট্রিক টন বাড়তি গম আমদানি হয়েছে।

লাল চিনি প্যাকেট বদলে বিক্রি হচ্ছে বেশি দামে : হাতবদল আর মোড়ক পাল্টে সরকারি লাল চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কেজিতে ৫০ টাকা। আর এই মূল্যবৃদ্ধির কাজটি করছে ৩ থেকে ৪টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এরা চিনি ও খাদ্য করপোরেশনের ডিলার থেকে কিনে গোপনে নিজেরাই প্যাকেটজাত করে। আর প্যাকেটের গায়ে বাড়তি দাম লিখে বাজারজাত করছে সরকারি চিনি। একটি গণমাধ্যমে অনুসন্ধানে ক্রেতা ঠকানোর এই চিত্র উঠে আসে। কর্পোরেশন ১১২ টাকা দাম ঠিক করে দিলেও মোড়কের গায়ে লেখা ১৬২ টাকা কেজি। এর মধ্যে মাশিরা বিডির প্যাকেটই খুচরা বাজারে সরবরাহ বেশি। প্যাকেটে প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা রাজধানীর ঝিগাতলা দেয়া হলেও কোনো হোল্ডিং নম্বর নেই।

পাইকারিতে ফের বাড়ছে পেঁয়াজ-রসুনের দাম : আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর গত ৫ জুন থেকে বাজারে কমতে থাকে পেঁয়াজের দাম। কোরবানির ঈদের আগ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকার পর পেঁয়াজের দাম আবারো বাড়তে শুরু করেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে ভোগ্যপণ্যের অন্যতম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ৩-৪ টাকা। ঈদের আগে যেখানে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছিল ৩৬-৩৭ টাকায়; এখন সেখানে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪২ টাকায়। বাজারে রসুনের সরবরাহ কমেছে। সরবরাহ সংকটের কারণেই এখন চায়না রসুনের দাম বাড়ছে। খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে গিয়ে দেখা গেছে, আড়তগুলোতে এখনো রসুনের স্বাভাবিক সরবরাহ রয়েছে।