‘প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি’
প্রকাশ : ১৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয়, তা যথাযথ নয় বলে মন্তব্য করেছেন একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, ব্যাংক খাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর অর্ধেকের মতো বছরের পর বছর ধরে মামলায় ঝুলে আছে। অর্থাৎ, যত দিন মামলাগুলো চলবে, তত দিন খেলাপি হিসেবে এগুলোকে গণ্য করা হবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক আরো বলেন, একইভাবে অবলোপন করা ৫৫ হাজার কোটি টাকাকেও খেলাপি হিসেবে দেখানো হয় না। এ দুটিকে যোগ করলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংকট কেন, সমাধান কীভাবে’ শীর্ষক আলোচনা সভায় মইনুল ইসলাম এসব কথা বলেন। গতকার শনিবার সকালে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের (আইইউবি) শিক্ষক জাহেদ উর রহমানের সঞ্চালনায় এতে আরও আলোচক ছিলেন পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা অংশীদার ও সিটিব্যাংক এনএ’র সাবেক প্রধান নির্বাহী মামুন রশীদ এবং প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন। জার্মান ফেডারেল শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প গবেষক জিয়া হাসান এতে সমাপনী বক্তব্য দেন। মইনুল ইসলাম বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের অর্থনীতি চালু আছে দেশে। লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে খেলাপি ঋণ। আমার ‘বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে খেলাপি ঋণ’ শীর্ষক এক গবেষণায় আমি দেখিয়েছি, ৭৭ শতাংশ খেলাপি ঋণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে হয়েছে। ২০১০ সালে এ গবেষণা বই আকারে বেরিয়েছে। ৩০ বছর ধরে খেলাপি ঋণ নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম বলেন, ‘দেখেছি সরকারের একটা দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে খেলাপিদের লাই দেওয়া, সুবিধা দেওয়া। ২০১৯ সালে আ হ ম মুস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হয়ে আসার পর থেকে এ প্রবণতা আরো বেড়েছে। একটার পর একটা আইনি সুবিধা দেওয়ার সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিছুদিন আগে ব্যাংক কোম্পানি আইনের পরিবর্তন করে তাদের আরো সুবিধা দেওয়া।’ দেশের ১ কোটির বেশি মানুষ প্রবাসে আছেন উল্লেখ করে মইনুল ইসলাম বলেন, তারা ব্যাংকিং চ্যানেল বা হুন্ডির মাধ্যমে যে অর্থ পাঠান, তা ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা পড়ে। সুতরাং, আমানতের ঘাটতির মধ্যে নেই দেশের ৬২টি ব্যাংক। তবে এ আমানত লুট হয়ে যাচ্ছে। ঋণ খেলাপিরা কোনো বিপদের কারণে ঋণ খেলাপি হননি। মামলাগুলোকে বছরের পর বছর ঝুলিয়ে রাখছেন তারা। তারা সুবিধা নিচ্ছেন এবং কোনো ধরনের নিয়ম মানছেন না। এমনকি খেলাপি ঋণের বেশির ভাগ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, দুবাই ইত্যাদি দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, পাচারকৃত অর্থের ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী ব্যবস্থা করেছিলেন ৭ শতাংশ কর দিয়ে সেই অর্থ ফেরত আনা, তা কাজে দেয়নি। একটি পয়সাও ফেরত আসেনি। পুঁজি পাচার নিয়ে অর্থমন্ত্রী একেবারেই নরম অবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। পুঁজি পাচারই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের জন্য দায়ী। এদিকে টাকার মান কমেছে ২৫ শতাংশ, যার কারণে মূল্যস্ফীতির তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। সারা দেশের অর্থনীতিতে বর্তমানে যে খারাপ অবস্থা, এর পেছনে ব্যাংক খাতে লুটপাটের কারণও দায়ী। মইনুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক সম্পত্তিতে পরিণত করা হয়েছে। এমন একটি দেশের নামও কেউ বলতে পারবেন না, যেখানে একটি গ্রুপের হাতে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কোনো সভ্য দেশের সরকার তা মেনে নিতে পারে না। পিডব্লিউসি বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা অংশীদার মামুন রশীদ বলেন, ‘ব্যাংক খাতের সমস্যা বলতে গেলে শুধু যে মন্দ ঋণের কথাই আসবে তা নয়। জবাবদিহি ও সুশাসনের অভাবও এখানে বড় সমস্যা। সন্ধ্যা ৬টার সময় একটি ব্যাংকের সিন্দুক থেকে বেশ কিছু টাকা বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পত্রিকায় শিরোনামও হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এর কী হলো, কেউ কিন্তু জানে না।