খুচরা বাজারে কৃত্রিম সংকট
আলুর বাজারে অস্থিরতা
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশে আলু উৎপাদনের শীর্ষ জেলা মুন্সীগঞ্জের ৬৩টি হিমাগারে চাহিদার চেয়েও দ্বিগুণ পরিমাণ আলুর মজুত রয়েছে। তবু সপ্তাহের ব্যবধানে খুচরা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কয়েক দফা বেড়েছে দাম। সাধারণ ক্রেতাদের অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসনের যথাযথ বাজার তদারকি না থাকায় নানা অজুহাতে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়িয়েছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুতে দামের পার্থক্য ১৫ থেকে ১৯ টাকা পর্যন্ত ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি খুচরা বাজারে ফের আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের। তবে এ নিয়ে বাজারে নানা অজুহাত রয়েছে খুচরা ব্যবসায়ীদের। কাঁচামাল ব্যবসায়ীদের দাবি, পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে আলুর দাম। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, এখনো পর্যাপ্ত আলুর মজুত রয়েছে জেলার বেশিরভাগ হিমাগারে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার ৬৭টি হিমাগারের মধ্যে বর্তমানে সচল থাকা ৬৩টি হিমাগারে (১৪ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত মজুত রয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩৩ মেট্রিক টন আলু। এর মধ্যে খাবার আলু মজুত রয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৯৫২ মেট্রিক টন। আর বীজ আলুর মজুত রয়েছে ৭৭ হাজার ৫৮১ মেট্রিক টন। খুচরা বাজারে কয়েক দফা মূল্য বৃদ্ধির পর বিগত ৩ সপ্তাহে (২২ জুন থেকে ১৪ জুলাই) পর্যন্ত ২১ দিনে হিমাগার থেকে বাজারজাত হয়েছে ১৮ হাজার ১৫৮ মেট্রিক টন আলু। অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছর মুন্সীগঞ্জে হেক্টরপ্রতি আলুর উৎপাদনে গড়ে খরচ হয়েছে ৩ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয়েছে ৩০ দশমিক ৭৫ মেট্রিক টন অথবা ৩০ হাজার ৭৫০ কেজি আলু। অর্থাৎ চলতি মৌসুমে আলুর উৎপাদন ও পরিবহন খরচসহ সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজিতে ১১ থেকে ১৩ টাকা। বর্তমানে হিমাগারের মজুতকৃত এসব আলু প্রায় একগুণ বেশি দামে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪১ থেকে ৪৬ টাকা পর্যন্ত। গত শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সদর উপজেলার মুক্তারপুর পুরাতন ফেরিঘাট ও চর মুক্তারপুর এলাকায়, বিক্রমপুর মাল্টিপারপাস কোল্ড স্টোরেজ, রিভারভিউ, কদম রসুল, এলাইট, নিপ্পন, দেওয়ান আইস, নিসান ও টঙ্গীবাড়ী কোল্ডস্টোরেজসহ আরো বেশ কয়েকটি হিমাগার ঘুরে দেখা গেছে, এসব হিমাগারে এখনো সংরক্ষিত বিপুল পরিমাণ আলুর প্রতিদিনের পাইকারি বেচাকেনা অব্যাহত রয়েছে। হিমাগারের ভেতরে সংরক্ষিত আলুর বাছাই প্রক্রিয়া শেষে বস্তাবন্দি করছেন শ্রমিকরা। টানা বেশ কয়েক বছরের লোকসান কাটিয়ে হাঁসি ফুটেছে কৃষক ও বেপারিদের চোখে-মুখে। হিমাগারগুলোতে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ২২ থেকে ২৬ টাকা পর্যন্ত। এতে ৫০ কেজি ওজনের প্রতিটি বস্তার দাম পড়ছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা। অথচ হিমাগারগুলো থেকে মাত্র ২ কিলোমিটার দূরের কাঁচামাল বিক্রির বেশ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, একই আলু সেখানে বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যে। অর্থাৎ পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজিতে ১৫ থেকে ১৯ টাকা খুচরা বাজারে বাড়তি দাম দিয়ে ভোক্তাদের খেতে হচ্ছে প্রতিদিনের খাবারের অন্যতম অনুষঙ্গ এ খাবার। স্থানীয় একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চলতি মৌসুমে উৎপাদিত আলুর প্রায় ৯৩ শতাংশ কৃষকরা বিক্রি করে দিয়েছেন ব্যবসায়ী বা বেপারিদের কাছে। তবে এখনো কিছু সংখ্যক কৃষকের আলু মজুত রয়েছে হিমাগারে। বাকি সবটুকুই ব্যবসায়ীদের হাতে। ফলে বাজারে আলুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হলেও প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে। বক্কর আলী নামের এক কৃষক বলেন, আমি বাপ-দাদার আমল থেকে ৩৫-৪০ বছর ধরে আলুর চাষাবাদ করছি। টানা বেশ কয়েক বছর ধরে লোকসান হলেও থেমে যাইনি। চলতি মৌসুমেও ফলন কিছুটা কম হয়েছে। তবু এবার সদর উপজেলার চরকেওয়ার এলাকায় প্রায় ১১৭ একর জমিতে আলুর চাষাবাদ করেছি। চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে জমি থেকে আলু উত্তোলন শেষে ৯ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে প্রতি কেজি আলু ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছি। মাত্র ৩-৪ মাসের ব্যবধানে এসব এখন খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে অন্তত ৩ গুণ বেশি দামে। ১০ টাকা কেজি দরের আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা কেজিতে। তবে সংরক্ষণ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে দাবি করে ভিন্ন অজুহাত রয়েছে পাইকারি ব্যবসায়ীদের। রসরাজ বাবু নামের স্থানীয় এক পাইকারি আলু ব্যবসায়ী বলেন, এবার চলতি মৌসুমে ৫ হাজার বস্তার বেশি আলু সংরক্ষণ করেছেন হিমাগারে। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে সংরক্ষণ ব্যয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার বস্তার বেশি আলুর মজুত রয়েছে মুক্তারপুর এলাকার কদম রসুল কোল্ড স্টোরেজে। মজুতকৃত এসব আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ২২ থেকে ২৬ টাকা কেজিতে। ৫০ কেজি ওজনের একেকটি আলুর বস্তা প্রায় ১৩০০ টাকা। তিনি বলেন, আমরা তো পাইকারি আলু ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক দামেই খুচরা ব্যবসায়ী ও বাজারের আড়তদারদের কাছে বিক্রি করছি। তবে কেন তারা খুচরা বাজারে আলুর দাম বৃদ্ধি করছে বিষয়টি প্রশাসনের খতিয়ে দেখা উচিত। বাজারে আলুর মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে অস্থিরতার পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ঢাকার বড় বড় কাঁচামালের আড়তদাররা। এমন একই অভিযোগ বাবুল পাইক, মো. আলম, আফসু বেপারি, দেলোয়ার মেম্বার, ইউনুস বেপারিসহ স্থানীয় প্রবীণ পাইকারি আলু ব্যবসায়ীদের। অন্যদিকে স্বাভাবিকের চেয়েও দ্বিগুণ মূল্যে খুচরা পর্যায়ে আলু কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা। তবু কয়েক দফা আলুর মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে নানা অজুহাত দিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। মুন্সীগঞ্জ কাঁচাবাজারের শাহ আলম ঢালী নামের এক খুচরা আলু বিক্রেতা বলেন, আমি ২৫-৩০ বছর ধরে কাঁচামালের ব্যবসা করে আসছি। কাঁচামালের দাম প্রতিদিন ওঠা-নামা করবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। আর আমাদের তো কোল্ডস্টোরেজ কিংবা হিমাগারের মজুত রাখা পাইকারি আলু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয়ের সুযোগ নেই। তারা এসব বিক্রি করে ঢাকার বড় বড় কাঁচামালের আড়তদারদের কাছে। সেখান থেকে কিনে এনে আমরা খুচরা বাজারে বিক্রি করি। সেখানে বেশি দামে কিনতে হয় বলেই এর সঙ্গে বিভিন্ন খরচের কারণে আমাদের খুচরা আলু একটু বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। গত বৃহস্পতিবার বিকালেও ঢাকা থেকে আমাদের ৩৯ টাকা কেজি আলু কিনে নিয়ে আসতে হয়েছে। বিভিন্ন খরচের কারণে এসব আলু আমরা ৪৬/৪৭ টাকা বিক্রি করছি এখন। প্রশাসনের জোরালোভাবে রাজধানীতে বড় কাঁচামালের আড়তগুলোতে তদারকি করা উচিত। একই মন্তব্য দেলোয়ার আলী, আব্বাস হোসেন, সুমন মিয়া, নান্নু বেপারিসহ একাধিক খুচরা বাজারের সবজি বিক্রেতার। তবে ভোক্তাদের অভিযোগ খুচরা বাজারে আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। অতিরিক্ত মুনাফার লোভে মূল্যবৃদ্ধি করে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
হিমাগারের আলু বিক্রি করছেন না মজুতদাররা: এদিকে জয়পুরহাটের হিমাগারগুলোতে বিপুল পরিমাণ আলু মজুদ থাকলেও বিক্রি করছেন না ব্যবসায়ীরা। ফলে আলুর দাম বেড়েই চলছে। এক মাস আগেও জয়পুরহাটের বিভিন্ন বাজারে অ্যাস্টেরিক, কার্ডিনাল ও ডায়মন্ড জাতের প্রতি কেজি আলুর খুচরা মূল্য ছিল ৩০ টাকা। সেই আলু এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি। আবার দেশি পাকড়ি (লাল গুটি) আলু ৪০ টাকার স্থলে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজি। বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলুর বড় ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বিক্রি না করায় বাজারে চাহিদামতো আলু মিলছে না।
ফলে এক মাসের ব্যবধানে জয়পুরহাটের বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি আলুর দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা।