চালের সংকট নেই

সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে নজরদারির তাগিদ

প্রকাশ : ২৪ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিয়ান স্ট্যালিন

সরকারের বর্তমান মজুত ২০ লাখ মেট্রিক টন। এ সময় মজুত ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন থাকলে সরকার স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকে। সংগ্রহ অভিযান চলমান রয়েছে। দেশে এখন চালের কোনো সংকট নেই। আগামী জুন পর্যন্ত সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই; বরং এবার ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকবে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছিল। গবেষণায় চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে চালকলের মালিক ও খুচরা বিক্রেতাদের অতিরিক্ত মুনাফার বিষয়টি উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর আমনের উৎপাদন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১ কোটি ৬৩ লাখ টন হবে। বোরো ২ কোটি ৪ লাখ টন ও আউশ ৩০ লাখ টন ধরে মোট উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৯৭ লাখ টন। দৈনিক জনপ্রতি ৪০৫ গ্রাম করে চালের ভোগ হিসাব করলে ১৭ কোটি মানুষের জন্য বছরে চালের প্রয়োজন হবে ২ কোটি ৫১ লাখ ৩০ হাজার টন।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের কাঁচামাল ও প্রাণিখাদ্য (নন-হিউম্যান) হিসেবে ১ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার টন ব্যবহৃত হবে। সুতরাং এরপর উদ্বৃত্ত থাকবে ৪২ লাখ টন। বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই। রাশিয়ার শস্য চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানো, ভারতের চাল রপ্তানি বন্ধ করার কোনো প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না। দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত আছে। সরকারের খাদ্য গুদামেও পর্যাপ্ত মজুত আছে। দেশের জন্য এ বছর কোনো চাল আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। আগামীতে আমন ফসল ভালো হলে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুত আছে। বর্তমানে মজুতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যশস্য রাখার জায়গার সঙ্কুলান হচ্ছে না। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, খাদ্যশস্য রাখার ব্যবস্থা করার জন্য তিন মাসের রেশন একবারে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এতে বেশ কিছুটা খালি হবে। ভারত বাসমতি বাদে সব ধরনের চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জনগণকে ভাবিয়ে তুলেছে। তবে ভালো খবর হলো বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতির কোনো সম্ভাবনাই নেই। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলে আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। তিনি বলেন, এটি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতার ফসল। আমন ও বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সংগ্রহের সিংহভাগ গুদামে চলে এসেছে। ধানও পর্যাপ্ত সংগ্রহ হয়েছে। অনেকে অতিরিক্ত ধান দেওয়ার জন্য তদ্বির করছে। আগস্টের মধ্যে আশাকরি সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা শতভাগ পূরণ হবে। খাদ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারের বর্তমান মজুত ২০ লাখ মেট্রিক টন। এ সময় মজুত ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন থাকলে সরকার স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকে।

সংগ্রহ অভিযান চলমান রয়েছে। সংগ্রহ করা খাদ্যশস্য রাখার জন্য আমরা খাদ্যগুদাম খালি করতে তিন মাসের রেশন একবারে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। ইতোমধ্যে সংস্থাকে চিঠি দিয়েছি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে দেশে মোট ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে ছয় লাখ মেট্রিক টন চাল সরকার আমদানি করেছে। বাকি সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন বেসরকারিভাবে আমদানি করা হয়েছে। এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, বেসরকারিভাবে মোট ১৮ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে সাড়ে চার লাখ মেট্রিক টন চাল দেশে এসেছে। এ বিষয়ে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলে আপাতত বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই। দেশে এবার বোরো ফলন ভালো হয়েছে। আশাকরি আমন ফসলও ভালো হবে। তবে কোনো কারণে আমন ফসল বেশি খারাপ হলে, হয়তো কিছু পরিমাণ চাল আমদানি করা লাগতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজন হলে আমরা ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে চাল আমদানি করতে পারব। তবে মনে হয় আমদানি করার কোনো প্রয়োজন হবে না। দেশে ফলন ভালো হয়েছে, অভ্যন্তরীণ মজুত ভালো, সরকারের সংগ্রহও ভালো। সেক্ষেত্রে আপাতত চাল আমদানির কোনো প্রয়োজন হবে না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গোটা বিশ্ব খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়। পরে তুরস্কের মধ্যস্থতায় রাশিয়া ও ইউক্রেনকে নিয়ে শস্য চুক্তি করা হয়। এতে মূল বিষয় ছিল আফ্রিকার মতো গরিব দেশে খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে হবে। কিন্তু ইউক্রেন আফ্রিকার নামে ইউরোপে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য রপ্তানি করে আসছে। যার একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রেও চলে যায়। এসব কারণে শস্য চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে রাশিয়া এই চুক্তির মেয়াদ নবায়ন না করে চুক্তি থেকে সরে আসে। আর রাশিয়া শস্য চুক্তি থেকে সরে আশায় বিশ্বব্যাপী আবার খাদ্য সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এরইমধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। আবার রাশিয়া শস্য চুক্তি থেকে সরে আসায় ভারত বাসমতি বাদে সব ধরনের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বিশ্বে যত চাল রপ্তানি করা হয় তার ৪০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। দেশটির এমন পদক্ষেপের ফলে বিশ্ববাজারে বহুলভাবে ব্যবহৃত খাদ্যটির দাম বাড়তে পারে বলে এক নোটে লিখেছে ডেটা বিশ্লেষণ সংস্থা গো ইন্টেলিজেন্ট। সংস্থাটি নোটে লিখেছে, ভারতে এই সিদ্ধান্তের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তুরস্ক, সিরিয়া, পাকিস্তানসহ আফ্রিকার দেশগুলো। এরইমধ্যে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে দেশগুলো। ভারতের খাদ্য ও ভোক্তাবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বৈশ্বিক বাজারে দেশটির সাদা জাতের চালের চাহিদা আগের বছরের একই সময়ের থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এর জেরে গত সেপ্টেম্বরে ভাঙা চাল রপ্তানি নিষিদ্ধের পাশাপাশি চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ অতিরিক্ত কর আরোপ করে ভারত সরকার। আর্থিক সংস্থা রাবোব্যাংকের বরাত দিয়ে বলা হয়, গত বছর ভারত এক কোটি তিন লাখ টন চাল রপ্তানি করে। তবে, রপ্তানি করা সব চালই ছিল সাদা জাতের।

ভারতের শূন্যস্থান পূরণের সামর্থ্য নেই বিকল্প সরবরাহকারীদের কাছে। মূলত ভারতের চাল বেশি আমদানি করে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র। এই শূন্যস্থান প্রতিস্থাপনের জন্য দেশগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহকারী নেই। চলতি সপ্তাহেই ইউক্রেন থেকে কৃষ্ণসাগর দিয়ে শস্য রপ্তানি চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছে রাশিয়া। এরপরই তারা জানায়, এখন থেকে ইউক্রেনীয় বন্দরগামী যে কোনো জাহাজকে সামরিক জাহাজ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

আর এতেই শস্যবাহী জাহাজ চলাচল কমে যাওয়ায় বিশ্ব বাজারে বাড়তে শুরু করেছে গম ও ভুট্টার দাম। এদিকে কৃষ্ণসাগরে সামরিক মহড়া চালিয়েছে রাশিয়ার নৌবাহিনী। শস্য চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর পর রাশিয়া জানায়, এই পথের যে কোনো জাহাজকে সামরিক জাহাজ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো চাল মজুত করার চেষ্টা করলে দেশের বাজার অস্থির হয়ে উঠতে পারে। এমনটাই আশঙ্কা করছেন চট্টগ্রামের চাল ব্যবসায়ী নেতারা। তবে পরপর দুই মৌসুম বোরো ও আমনের বাম্পার ফলনে বাংলাদেশে আপাতত চালের কোনো সংকট নেই।

চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী চাল বাজারে দেখা গেল, চালবাহী ট্রাক, মিনি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের সারি। বিভিন্ন মোকাম থেকে প্রতিদিন আড়াইশ থেকে ৩০০ চালবাহী গাড়ি আসছে এসব বাজারে। যে কারণে ভারতের চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞাকে তেমন সংকট হিসেবে দেখছেন না মাঠ পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। আগে বাংলাদেশ ২২ থেকে ২৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানি করলেও এখন তা ৮ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টনে নামিয়ে আনা হয়েছে। এদিকে, গত বছর তিন মৌসুমে বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকার কারণে দেশে পর পর আমন এবং বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। সদ্যবিদায়ী বোরো মৌসুম এবং হাওড়ের ধান বাজারে চলে আসায় পর্যাপ্ত চালের মজুত সৃষ্টি হয়েছে। ফলে গত দুমাস ধরেই স্থিতিশীল রয়েছে দেশের চালের বাজার। বিশেষ করে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা মোটা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২০০ টাকায়। এছাড়া প্রতি বস্তা ঝিরাশাইল ২ হাজার ৮০০ টাকা, পারী সেদ্ধ ২ হাজার ৫৫০ টাকা, স্বর্ণা ২ হাজার ৫০০ টাকা, গুটি স্বর্ণা ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মিনিকেট ২ হাজার ৪৫০ টাকা।

আর আতপ চালের মধ্যে ৫০ কেজি প্রতি বস্তা বেথি আতপ ২ হাজার ৪০০ টাকা, মিনিকেট ৩ হাজার টাকা, কাটারি ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং পাইজাম ২ হাজার ৫০০ টাকা। তবে গত কয়েক বছর ধরে বেশ কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পগ্রুপ চালের ব্যবসা করায় বাজারে সিন্ডিকেট প্রথা শুরু হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাজারের পরিবর্তে মোকাম থেকেই চাল সংগ্রহ করে। এমনকি কম শুল্কে আমদানি করা চাল প্রতিষ্ঠানগুলো কারসাজির মাধ্যমে বেশি দামে বিক্রি করেছিল বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের এ নিষেধাজ্ঞার সুযোগে যাতে কর্পোরেট হাউজগুলো কোনো রকম চাল মজুত করতে না পারে সে লক্ষ্যে প্রশাসনের তদারকির কথা বলছেন চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম। তিনি বলেন, এ ধরনের করপোরেট মিলাররা বড় ধরনের ধান মজুত করে রাখেন। সরকারকে তাদের দিকে নজরদারি করতে হবে যাতে করে তারা ভারতের এ রফতানি বন্ধের সুযোগ না নিতে পারে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ জুলাই পর্যন্ত বোরো মৌসুমে ১ লাখ ৫৮ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ধান এবং ৮ লাখ ৮৩ হাজার ২৯৪ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশ শুধুমাত্র ভারত থেকেই চাল আমদানি করে না, মিয়ানমারের পাশাপাশি থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকেও প্রচুর পরিমাণে চাল দেশে আসে। কাজেই ভারত চাল রপ্তানি বন্ধ করলেও বিকল্প বাজার হিসেবে এখনো আছে অন্য তিনটি দেশ। সেই সঙ্গে দেশের মোকাম ও গুদামগুলোতে বোরো মৌসুমে উৎপাদিত চালের মজুত রয়েছে। তাই আগামীতে চাল নিয়ে সাধারণ ক্রেতারা যেন শঙ্কিত না হয়, এমনটাই বলছেন ব্যবসায়ীরা।