দেশে মাছ ধরার ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকলেও গত কয়েক বছরে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ক্রমেই কমেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কারণগুলোর মধ্যে অবাধে জাটকা নিধন ও নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার ও বৃষ্টিপাতের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আছে। শুধু জাটকা ধরার কারণে ২০২১ সালে ৫৮ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ আহরণ থেকে বঞ্চিত হয় দেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মতে, নদীর মোহনায় নিষিদ্ধ জালের ব্যবহার সমুদ্র থেকে প্রজনন ও ডিম ছাড়তে আসা ইলিশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। মাছের উৎপাদন বাড়াতে সরকার বছরে ২ বার ইলিশসহ অন্যান্য বিপন্ন প্রজাতির মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে। বছরের প্রথম নিষেধাজ্ঞা ১ মার্চ থেকে ২ মাস স্থায়ী হয় যাতে রেণুপোনা বাড়তে পারে। দ্বিতীয় নিষেধাজ্ঞা ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়ে ২২ দিন স্থায়ী হয়, যাতে ইলিশসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ ডিম ছাড়তে পারে।
নির্বিচারে মাছ ধরা ও বিভিন্ন জলজ প্রজাতি শিকার বন্ধে ২০০১ সাল থেকে দেশে মনোফিলামেন্ট সিন্থেটিক নাইলন ফাইবার দিয়ে তৈরি জাল নিষিদ্ধ করে সরকার।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শিথিল নজরদারির সুযোগে জেলেদের একটি অংশ এ জাল ব্যবহার করছেন, যা ইলিশের উৎপাদন ব্যাহত করছে। বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে বছরের পর বছর ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া এবং জুন-জুলাই মাসে যখন প্রচুর ইলিশ পাওয়ার কথা, সেটিও যখন একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে, তখন বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে ২০১৯ সালে ২৪৬ কোটি টাকার ‘ইলিশ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ হাতে নেয় মৎস্য অধিদপ্তর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। ৪ বছরে বার্ষিক উৎপাদন ৬ লাখ ২০ হাজার টন বা ১৬ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মৎস্য অধিদপ্তর। তবে ৩ বছরে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম।
২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। ২০২১-২২ সালে প্রবৃদ্ধির হার আরও কমে শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। মৎস্য অধিদপ্তর এখনো ২০২২-২৩ অর্থবছরের তথ্য প্রকাশ করেনি। বিএফআরআইর এক জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জানান, ২০২১ সালে অবৈধভাবে জাটকা ধরার কারণে প্রায় ৫৮ হাজার ৮০০ টন ইলিশ থেকে দেশবাসী বঞ্চিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজি ইলিশের দাম ১ হাজার টাকা ধরে নিলে দেশের প্রায় ৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।’ পটুয়াখালীর মহীপুর ও খেপুপাড়া, বরগুনার পাথরঘাটা এবং ভোলার মনপুরা ও দৌলতখানসহ ১০ মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে জরিপ চালিয়ে এ তথ্য পেয়েছে বিএফআরআই। তিনি উল্লেখ করেন যে, মা ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য সমুদ্র থেকে নদীতে আসার চেষ্টা করলেও জেলেদের ১০০ থেকে ২০০ গজের ব্যবধানে ৩ থেকে ৪ হাজার ফুট লম্বা চিকন জাল পেরিয়ে আসা তাদের জন্য প্রায় দুঃসাধ্য। এই ধরনের প্রতিবন্ধকতা অনেক ইলিশকে তাদের জীবনচক্রে ডিম দেওয়ার সুযোগ পেতে বাধা দেয়। আর নদীতে বড় ইলিশ কম ধরার পেছনে এটি অন্যতম প্রধান কারণ।’এ ছাড়া, তিনি কম মাছ পাওয়ার জন্য বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং নাব্যতা সংকটকেও দায়ী করেন।
ইলিশ বাণিজ্যে জড়িতরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশের দিকে আঙুল তুলেছেন। তাদের মতে, যতদিন রক্ষাকারীরা শিকারীর বেশে কাজ করবে, ততদিন সরকারের কোনো উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে না। চাঁদপুরে নিষেধাজ্ঞার সময় অবৈধভাবে মাছ ধরা রোধে পাহারায় নিয়োজিত এক জেলে অভিযোগ করে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরার জন্য নৌপুলিশ প্রতিটি নৌকা থেকে ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে।
গত ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত এই জেলে আরও বলেন, নৌ পুলিশ জেলেদের সারা বছর নিষিদ্ধ জাল ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার জন্যও ঘুষ নেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাঁদপুরের এক ঊর্ধ্বতন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, এই অবৈধ কর্মকাণ্ড কারো অজানা নয়। ‘জেলা সমন্বয় সভায় প্রায়ই এ নিয়ে আলোচনা হয়। আমাদের বলা হয় যে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু, তারপরও অবৈধ কাজ চলছেই,’ বলেন তিনি। চাঁদপুর নৌ পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার তোফাজ্জেল হোসেন বলেন যে, তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই তারা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকেন।