২০০৮ সালের গোড়ার দিকে জাপান সরকার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা বাড়ানোর মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাতে ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ নীতি ঘোষণা করেছিল। চীনে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, ‘বৈশ্বিক কারখানা’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠা দেশটিতে দক্ষ কর্মীর অভাব ও সেখানে জাপানি বিনিয়োগকারীদের লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় টোকিও এই উদ্যোগ নিয়েছিল।’ চায়না প্লাস ওয়ান স্ট্র্যাটেজি’ এত ভালোভাবে কাজ করছে যে, বাংলাদেশ থেকে পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের চালান দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের চালান জাপানে ১৭৫ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ২০০৮ সালে জাপানের রিটেইল জায়ান্ট ফাস্ট রিটেইলিং তাদের ক্রেতাদের জন্য পোশাক নিতে ঢাকায় অফিস খোলে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপানে বাংলাদেশ প্রথম রপ্তানি করে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সূর্যোদয়ের দেশটি থেকে আয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
ওই বছর রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। দীর্ঘদিন ধরে মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করে আসা জাপানের বাজারে রপ্তানির উচ্চতর প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে তৈরি পণ্যের মান উন্নয়নের একটি প্রমাণ। ২০১৯-২০ সালে করোনা মহামারির সময়ও জাপানের বাজার বাংলাদেশিদের হতাশ করেনি। তখন বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে মারাত্মক সমস্যা সত্ত্বেও বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানে বাংলাদেশ ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। ২০২২-২৩ সালে দেশের রপ্তানিকারকরা আগের বছরের তুলনায় ৪০ দশমিক ৭৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পায়। তখন রপ্তানি ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। এর আগের অর্থবছরে তা ছিল ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক রপ্তানি আরও বেড়ে যাওয়ায় আয় বেড়েছে ৪৫ দশমিক ৬২ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি আয় ১ দশমিক ০৯ বিলিয়ন ডলার বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের পণ্য উৎপাদনকারীরা ২০৩০ সালের মধ্যে জাপান থেকে পোশাক রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য ১০ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করেছেন। ২০১১ সালে জাপান রুলস অব অরিজিন শিথিল করে এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) থেকে নিটওয়্যার পণ্য আমদানিতে শুল্ক তুলে নেওয়া শুরু করলে সেখানে পোশাকের চালান বেড়ে যায়। এটি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ স্বস্তিকর ছিল। কেননা, জাপান তার দেশীয় শিল্পকে রক্ষা করতে অনেক বছর ধরে নিটওয়্যার পণ্যগুলোয় ১৭ শতাংশ শুল্ক দিয়ে রেখেছিল। তবে, ওভেন পণ্যগুলো দীর্ঘদিন ধরে শুল্ক অগ্রাধিকার পেয়ে আসছে। ২০১৪ সালে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক আসে। সে বছর জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ঢাকা সফর করে বাংলাদেশের জন্য ‘বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট ইনিশিয়েটিভ’ চালু করেন।
২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে জাপান থেকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বছরে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় দেশে মোট এফডিআই ৩৮০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। মূলত তৈরি পোশাক, ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন, হেলথকেয়ার ও মোটরসাইকেল খাতে সরাসরি বিনিয়োগ এসেছে। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) তথ্য অনুসারে, এশিয়ায় জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, এটি এর মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। বর্তমানে প্রায় ৩৫০টি জাপানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। ২০১৫ সালে এই সংখ্যা ছিল ২৪৫টি। সরকার নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ডেডিকেটেড জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পর বিনিয়োগ আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও সুমিতোমো কর্পোরেশনের যৌথ মালিকানাধীন অঞ্চলটি গত ডিসেম্বরে চালু হয়।