ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের দাম

নেপথ্যে কারসাজি
নিয়ন্ত্রণহীন ওষুধের দাম

একই ওষুধ, কোম্পানিভেদে দামের বিশাল ফারাক। কোনো কোনো ওষুধের দামের পার্থক্য পাঁচ গুণ। বাংলাদেশে দেড় হাজারের বেশি ধরনের ৩৫ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ রয়েছে এর মধ্যে শুধু ১১৭টি ওষুধের মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মতো সম্প্রতি অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশে এখনো মানুষের চিকিৎসা বাবদ মোট খরচের বড় অংশই ওষুধের পেছনে ব্যয় হয়, সেখানে ওষুধভেদে বড় ব্যবধানে দাম বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

কোম্পানিগুলো নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছে। গত বছরের জুন-জুলাইয়ের পর সেপ্টেম্বরেই অন্তত ৫০ ধরনের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। আমদানি করা ওষুধের দামের ওপর কারো হাত নেই। যে যার মতো দামে বিক্রি করছে। এক্ষেত্রেও বিশ্ববাজার, ডলার, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই নিয়মিত নজরদারি। এ সুযোগে ফার্মেসি মালিকরা বেশি দাম নিচ্ছেন। উচ্চমূল্যের পাশাপাশি আছে ভেজাল ওষুধ। সরকারি হাসপাতালগুলোয় ওষুধ কেনায় আছে দুর্নীতিও। ওষুধের বাজার ঘিরে নৈরাজ্য থামানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় উচ্চমূল্য জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে অনেক রোগী কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস চেপে ফার্মেসির সামনে থেকে শূন্যহাতে ফিরছেন। কেউ কেউ সামান্য ওষুধ কিনলেও বাকিগুলো খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগপ্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন ছেড়ে দিলে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক জটিলতার সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় সুদূরপ্রসারী চ্যালেঞ্জ বাড়াবে। ওষুধের বাড়তি মূল্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সম্প্রতি সরকার সর্বোচ্চ ১৩৪ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কিছু কিছু ওষুধের দামের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যে প্রস্তাব করেছে, সরকার তার চেয়ে বেশি মূল্য বেঁধে দিয়েছে- এমন ঘটনাও আছে। এসব কারণে আগে যে দামে ওষুধ কেনা যেত, এখন তার চেয়ে কয়েকগুণ টাকা গুনতে হচ্ছে রোগীদের। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের বাজারে ওষুধের বাড়তি দাম জোগাড়ে হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ক্রেতারা। খোলাবাজারে একই ওষুধের দামের ভিন্নতা আছে।

সরকারি হাসপাতালেও এ ধরনের চিত্র দেখা গেছে। এছাড়া গ্রামের দুর্গম এলাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের এবং ভেজাল ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে ২১৩ স্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে, যা দেশের মোট ওষুধের চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ করছে। অপর দিকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে। ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত বাংলাদেশে ওষুধের বাজারের আকার ছিল ৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। গত একদশকে বাজার ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০২৭ সালের মধ্যে এটি ৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, লিকুইড প্রিপারেশন, ড্রাই সাসপেনশন, ইনজেকশন, ন্যাজাল স্প্রে ও স্যাশের মাধ্যমে গ্র্যানিউলসহ প্রায় সব ধরনের ডোসেজ উৎপাদনে সক্ষম। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ইউরোপের ১৫৭ দেশে পণ্য রপ্তানি করে থাকে। গত ৭ বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি ১১ শতাংশেরও বেশি বেড়ে ১৮৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। দেশের ওষুধ শিল্পের অগ্রগতির কারণে তুলনামূলক কম খরচেই জীবন রক্ষাকারী ওষুধ কিনতে পারছেন সাধারণ মানুষ। তবে, ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করতে ক্রেডিট লেটার (এলসি) খুলতে সমস্যায় পড়ছেন ওষুধ প্রস্তুতকারীরা। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সম্প্রতি দেশের ওষুধ রপ্তানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেছে।

গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ওষুধের চালান ১২ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ কমে ৯২ দশমিক ৭৮ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। দেশে বছরে প্রায় ২৫ হাজার রকমের ওষুধ তৈরি হয়। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৪ হাজার ওষুধ পরীক্ষা করে দেখার সামর্থ্য আছে সরকারের। ফলে বিপুল পরিমাণ ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিএইচও) এর তথ্য অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলির বাজারে যে ওষুধ বিক্রি হয় তার ১৫ শতাংশ ওষুধ নিম্নমানের, ভেজাল বা নকল। ভেজাল বা নকল ওষুধ শনাক্তে সরকারের পাশাপাশি নাগরিকেরও দায়িত্ব রয়েছে। একজন নাগরিক যখন ওষুধ কিনতে যান তখন তিনি খুব সহজেই সেটি যাচাই করে নিতে পারেন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পণ্য যাচাই-বাছাই করা ভোক্তার অধিকার। কেউ যাচাই-বাছাইয়ে বাধা দিলে তার শাস্তির বিধান রয়েছে। ১৯৮২ সালে ওষুধনীতি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হয়। এর মূল কথা ছিল, ওষুধের মান নিশ্চিত করবে কোম্পানি। নজরদারি ও দাম নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার। কিন্তু ১৯৯৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কোম্পানির হাতে দেওয়া হয়। এরপর থেকে কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে। তবে অত্যাবশ্যকীয় তালিকাভুক্ত ১১৭টি জেনেরিকের ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। ‘প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি-১৯৯২’ বা মূল্য নির্ধারণ নীতি অনুযায়ী, প্রতি বছর অত্যাবশ্যকীয় তালিকাভুক্ত ওষুধের মূল্য সমন্বয় করার কথা রয়েছে। তবে ১৯৯২ সালে ওই নীতিমালা হওয়ার পর ২০১০, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে তিন দফায় এগুলোর মধ্যে কিছু ওষুধের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত